যেভাবে স্থানীয় নির্বাচন চায় সংস্কার কমিশন

প্রথম নিউজ, অনলাইন: স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের আগে, না পরে—এ বিতর্কে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ বেড়েছে। নির্বাচনব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন জাতীয় নির্বাচনের আগেই স্থানীয় সরকারের পক্ষে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এর পক্ষে জনমত জরিপও প্রকাশ করে বলেছে, ‘৬৪.৬৫ শতাংশের মত জাতীয় নির্বাচনের আগেই স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে।’ জামায়াতে ইসলামী সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে মত প্রকাশ করেছে।
কিন্তু বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো চাচ্ছে আগে জাতীয় নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের দাবিকে বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ সন্দেহের চোখেও দেখছেন।
গত শুক্রবার কোনো দলের নাম উল্লেখ না করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেছেন, ‘একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক করছে। তারা বলছে, স্থানীয় নির্বাচন আগে হতে হবে, তার পরে সংসদ নির্বাচন হবে।
স্থানীয় নির্বাচন আগে, নাকি সংসদ নির্বাচন আগে, এই কথাগুলো আসছে কেন?’
গত ৮ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের (ইআইবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বিয়ারের সঙ্গে আলোচনার সময় বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে, যেন স্থানীয় সরকার সত্যিই স্থানীয় সরকার থাকে এবং একটি সরকার নিশ্চিত করা যায়।
নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন না করার পক্ষে মতামত দিলেও ১১ ফেব্রুয়ারি বলেছে, সরকার চাইলে আগে স্থানীয় নির্বাচনও করা যেতে পারে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া জানিয়েছেন, সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে এ নিয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ অবস্থায় অনেকেই জানতে আগ্রহী, স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবারও কি আগের পদ্ধতিতেই হবে, নাকি সংস্কার কমিশন থেকে যে পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছিল তার বাস্তবায়ন হবে?
এ ছাড়া নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয় সরকারগুলোর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ বছরই করতে গেলে বর্তমান পরিষদ ভেঙে দিতে হবে। কারণ পাঁচ বছর মেয়াদের ইউনিয়ন পরিষদের দশম সাধারণ নির্বাচন শুরু হয়েছিল ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল, আর শেষ হয় ২০২২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি।
অন্তর্বর্তী সরকার অন্য স্থানীয় সরকারগুলো বিতর্কিত নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করলেও দেশের প্রায় সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদে তা করা হয়নি। আবার ইউনিয়ন পরিষদ বাদ রেখে অন্য স্থানীয় সরকারগুলোর নির্বাচন করতে গেলেও যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন।
এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজন অতীতে ভালো উদ্দেশ্যে করা হয়নি। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন দল গঠন বা পছন্দের কোনো দলকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে এ ধরনের নির্বাচন হয়েছে। সে কারণে এবারও আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সুপারিশ, দাবিতে সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের অন্যতম সদস্য ড. আব্দুল আলীম বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করতে হলে বর্তমান পরিষদ বিলুপ্ত করে নির্বাচন করতে হবে। কারণ বর্তমান পরিষদের মেয়াদ শেষ হয়নি। উপজেলা, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন—এসব স্থানীয় সরকারের যেকোনো একটির নির্বাচন করা যেতে পারে। সবগুলোর নির্বাচন করতে হলে দুই বছর সময়ের প্রয়োজন।
এ ছাড়া নতুন পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে হলে ভোটার ও প্রার্থীদের সচেতন করার জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। আইন সংশোধনও দরকার। সবচেয়ে আগে দরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ। রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, নির্বাচনব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন স্থানীয় সরকার নির্বাচন সংসদীয় পদ্ধতিতে করতে চাচ্ছে। এতে মেয়র, চেয়ারম্যান পদে সরাসরি ভোট হবে না। সরাসরি ভোট হবে সদস্য ও কাউন্সিলর পদে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সদস্য ও কাউন্সিলর পদে সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিরা আসতে চান না। কিন্তু মেয়র, চেয়ারম্যান হতে চাইলে আগে সদস্য ও কাউন্সিলর পদে তাঁদের নির্বাচিত হতে হবে। এ কারণে মেয়র, চেয়ারম্যান পদের উপযুক্ত লোকরা সংসদীয় পদ্ধতির নির্বাচন চান না বলেই জেনেছি।
তিনি আরো বলেন, জাতীয় সংসদের নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সুপারিশ বা দাবি সন্দেহ সৃষ্টি করছে। কারণ আইয়ুব খান থেকে শুরু করে অনেকেই ক্ষমতায় থেকে দল গঠনের জন্য বা নিজের পছন্দের দলের শক্তি বাড়ানোর জন্য জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করেছেন। আবার এ কথাও ঠিক যে দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন প্রভাবমুক্ত হতে পারে না।
আগেই ইউপি নির্বাচন! :
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনই আগে করার চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে। কারণ এ নির্বাচনটিই স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। এতে দেশব্যাপী ভোটারদের ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকে। তবে এই আশঙ্কাও রয়েছে যে জাতীয় সরকারের আগে এ নির্বাচন দিলে আওয়ামী লীগের অনেকে নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেন।
সর্বশেষ নির্বাচনে ৬২ শতাংশ ইউপিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা চেয়ারম্যান পদে জয়ী হন। আর এ পদে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দলটির বিদ্রোহীরা জয় পান ২২ শতাংশ ইউপিতে। এ ছাড়া দলীয় মনোনয়নের বাইরে বিএনপির বিদ্রোহীরা জয় পান ৮ শতাংশ ইউপিতে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এ ইউপি চেয়ারম্যানদের মধ্যে প্রায় এক হাজার ৪০০ ইউপি চেয়ারম্যান লাপাত্তা বলে জানা যায়।
সংস্কার কমিশন যেভাবে স্থানীয় নির্বাচন চায় :
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. তোফায়েল আহমেদ সম্প্রতি কালের কণ্ঠের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বর্তমানে জাতীয় সরকার পার্লামেন্টারি বা সংসদীয়। কিন্তু স্থানীয় সরকার প্রেসিডেনশিয়াল বা রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের মতো। স্থানীয় সরকার হচ্ছে এক ব্যক্তিসর্বস্ব, মেয়র বা চেয়ারম্যাননির্ভর। কাউন্সিলর বা সদস্যদের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও সংসদীয় পদ্ধতিতে হওয়া দরকার। মেয়র বা চেয়ারম্যান পদে সরাসরি ভোট হবে না; ভোট হবে কাউন্সিলর বা সদস্য পদে।
নির্বাচিত কাউন্সিলর বা সদস্যরা তাঁদের মধ্য থেকে একজনকে মেয়র বা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করবেন। তবে যেহেতু আমি স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি, সেহেতু এখন এ বিষয়ে আমার নিজস্ব প্রস্তাবের বাইরে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা এবং তাঁদের সুপারিশের ভিত্তিতেই সুপারিশ রাখা হবে।
তবে এরই মধ্যে যে প্রস্তুাব পেয়েছি, তাতে স্থানীয় সরকারের সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ওয়ার্ডগুলোর সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে ঘূর্ণায়মাণ পদ্ধতিতে নারীদের জন্য ওয়ার্ড নির্ধারণ করা দরকার। ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ডের সংখ্যাও জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্ধারণ হওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদগুলোর ওয়ার্ডসংখ্যা ৯। ভোটারসংখ্যার ভিত্তিতে বড় ইউনিয়ন পরিষদগুলোর ওয়ার্ডসংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।
বর্তমান আইন অনুসারে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ফুল টাইম চাকরি করেন—এমন কেউ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। আমি মনে করি, এই আইন বাতিল করা দরকার। ইউরোপের দেশগুলোর মতো নির্বাচনে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরতদেরও অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকা দরকার। স্থানীয় সরকারের সদস্য বা কাউন্সিলরদের কাজ ফুলটাইম নয়।
ফুলটাইম কাজ হচ্ছে মেয়র বা চেয়ারম্যানদের। মেয়র বা চেয়ারম্যানরা তাঁদের কাজে সহায়তার জন্য দু-তিনজন কাউন্সিলর বা সদস্য নিয়ে নির্বাহী কাউন্সিল গঠন করতে পারেন। এই নির্বাহী কাউন্সিলের সদস্যদের কাজ হবে সার্বক্ষণিক এবং তাঁরা মাসিক ভাতা পাবেন। অন্যরা পাবেন মিটিংয়ে যোগ দেওয়ার জন্য বিশেষ ভাতা।
আর নির্বাচন ছাড়াও স্থানীয় কাঠামোগত সমস্যাও রয়েছে। ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদ নির্বাচন এক রকম নয়। ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নির্বাচন এক রকম না। উপজেলায় তিনটি পদে একই ধরনের নির্বাচন হয়। জেলা পরিষদে সে অর্থে নির্বাচনই হয় না। এই তিন প্রতিষ্ঠানের কাঠামো ও নির্বাচন একই রকম হওয়া দরকার।’
গত ২৫ জানুয়ারি তিনি সাংবাদিকদের জানান, পৌরসভা-সিটি করপোরেশনের মেয়র ও ইউনিয়ন-উপজেলা-জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নিরক্ষর ও স্বল্পশিক্ষিতরা নির্বাচন করতে পারবেন না। এসব পদে নির্বাচিত হতে লাগবে ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রি।
ড. তোফায়েল আহমেদ গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, পূর্ণাঙ্গ সংস্কার প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে আমাদের আরো সময় প্রয়োজন। আগামী সোমবার অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা আমাদের প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেব।