যেভাবে এমিরেটস হয়ে উঠল বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক বিমান সংস্থা

প্রথম নিউজ, অনলাইন: একজন সত্যিকারের পথিকৃৎ, বুত্রোস বুত্রোস। তিনি এমিরেটসে যোগ দিয়েছিলেন ৩৫ বছর আগে, যখন এই এয়ারলাইনসটি ছিল মাত্রই নবজাতক। তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি, একদিন এটি বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক এয়ারলাইনস হবে। আর এ মাসেই এমিরেটস তাদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ আয়, ২১ বিলিয়ন দিরহাম লাভ ঘোষণা করেছে।
সাহসী সিদ্ধান্ত থেকে শুরু, বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব
১৯৯১ সালে এমিরেটসে যোগ দিয়েছিলেন বুত্রোস, যখন এই কম্পানি জন্মের ছয় বছর অতিক্রম করেছে মাত্র। তখন এয়ারলাইনের বহরে ছিল মাত্র সাতটি বিমান ও ১১টি গন্তব্য। খালিজ টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি মৃদু হেসে বলেন, ‘তখন কেউ আমাদের গুরুত্ব দিত না।’ সেখানে তিনি ট্রাইব মার্কেটিং সামিটে প্রধান বক্তা ছিলেন।
কিন্তু যখন বিশ্ব হাসছিল, প্রকল্পটিকে তেল-সমর্থিত কল্পনা বলে উপহাস করছিল, তখন এমিরেটসের নেতৃত্ব বিমান সংস্থাটিকে বিশ্ব মঞ্চে নিয়ে গিয়েছিল এবং দুবাইকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করে তোলে।
বুত্রোস বলেন, ‘আমরা আলাদা, এটাই আমাদের সফলতার মূল কারণ। ১৯৯২ সালে আমরা প্রথম এয়ারলাইনস হিসেবে প্রতিটি সিটে ইন-ফ্লাইট স্ক্রিন চালু করি, এমনকি ইকোনমি ক্লাসেও। পুরো ইন্ডাস্ট্রি আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করত।
’
তিনি বলেন, ‘তারা ভাবত, ওরা জানে না কী করছে— শুধু টাকাই আছে, তেল কম্পানি ভরসা। আমি ৩৫ বছর ধরে প্রমাণ করছি — দুবাইয়ের কাছে তেল নেই, কাজেই আসুন এটিকে তেলের টাকা বলা বন্ধ করি।’ তিনি আরো বলেন, একটি ছোট উপসাগরীয় রাষ্ট্র থেকে একটি বিমান সংস্থার উত্থানকে ঘিরে একসময় যে সংশয় ছিল, এটি তার প্রতিফলন।
১৯৮৯ সালে প্রথমবার দুবাই এসেছিলেন সাংবাদিক হিসেবে, একটি এয়ারশো কাভার করতে। তিনি বলেন, ‘তখনই বুঝেছিলাম, এই জায়গা শুধু উন্নতির দিকেই এগোবে।
’ এরপর সাহস করে যুক্তরাজ্য থেকে পাড়ি জমান এমিরেটসে যোগ দিতে। তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় বলি, আমি দুবাই ও এমিরেটসের ভিশনে বিশ্বাসী।’
তিনি যে বিভাগে কাজ শুরু করেন, সেটিই পরবর্তী সময়ে এমিরেটসের করপোরেট কমিউনিকেশন, মার্কেটিং ও ব্র্যান্ড বিভাগের নেতৃত্বদানকারী স্তম্ভ হয়ে ওঠে। এখান থেকে শুরু হয় এমিরেটসের স্পোর্টস স্পন্সরশিপ, বিশ্বজুড়ে জেনিফার অ্যানিস্টন থেকে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো পর্যন্ত তারকাদের নিয়ে ক্যাম্পেইন।
বুত্রোস বলেন, ‘১৯৮৫ সালে শেখ মোহাম্মদ বলেছিলেন, ভালো করো, ভালো দেখাও এবং লাভ করো। তখন তিনি প্রথম ও শেষ ১০ মিলিয়ন ডলারের একটি চেক দেন এবং বলেন, ‘এটা তোমাদের টাকা, পরে আর চাইতে এসো না।’ আজ এমিরেটস বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক এয়ারলাইনস।
সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, এমিরেটস করপূর্ব মুনাফা করেছে ২১.২ বিলিয়ন দিরহাম (৫.৮ বিলিয়ন ডলার), যা গত বছরের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি। আয় হয়েছে ১২৭.৯ বিলিয়ন দিরহাম (৩৪.৯ বিলিয়ন ডলার) — ৬ শতাংশ বৃদ্ধি। মার্চ ৩১, ২০২৪ অনুযায়ী নগদ সম্পদ ৪৯.৭ বিলিয়ন দিরহাম (১৩.৫ বিলিয়ন ডলার), যা ১৬ শতাংশ বেশি। এই সাফল্য এসেছে এমন একসময়ে, যখন বৈশ্বিক মহামারি বিমান চলাচলে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংকট এনেছে। সাফল্যের পর শেখ মোহাম্মদ বলেন, ‘এমিরেটস শুধু পরিবহন নয়, এটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থনৈতিক রূপান্তরের হাতিয়ার, বিশ্বজুড়ে সংযোগ তৈরি করা এক কৌশলগত সেতু।’
ইকোনমি ক্লাসে বিনা মূল্যে বিনোদন, প্রশিক্ষিত কেবিন ক্রু ও অসাধারণ কল সেন্টার কর্মীদের মাধ্যমে এমিরেটস বিমানযাত্রাকে এক অনন্য অভিজ্ঞতায় পরিণত করেছে। চেলসি ফুটবল ক্লাব দিয়ে শুরু, আজ এমিরেটস নাম রয়েছে বিশ্বের বড় বড় অ্যাথলেটের জার্সিতে এবং বিভিন্ন স্টেডিয়ামে। রাগবি, ক্রিকেট, এনবিএ, হর্স রেসিং, টেনিস, ফুটবল — সব জায়গায় এমিরেটসের উপস্থিতি। তাদের মার্কেটিং বাজেটের ৫০ শতাংশ খরচ হয় কেবল স্পোর্টস স্পন্সরশিপে।
বিশ্বতারকাদের সঙ্গে বিজ্ঞাপন বিপ্লব
পেনেলোপে ক্রুজ, ক্রিস হেমসওয়ার্থ থেকে শুরু করে জেনিফার অ্যানিস্টনের মতো তারকারা এমিরেটসের বিজ্ঞাপনে মুখ হয়েছেন। অ্যানিস্টনের ক্যাম্পেইনে ১৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে, যার প্রডাকশন খরচই ছিল ১০ মিলিয়ন ডলার।
সবচেয়ে সফল বিজ্ঞাপন, বুর্জ খলিফার চূড়ায় একজন কেবিন ক্রু। এক্সপো ২০২০ দুবাইয়ের প্রচারণার জন্য বুর্জ খলিফার চূড়ায় কেবিন ক্রুর উপস্থিতি নিয়ে তৈরি বিজ্ঞাপনটি ৬০ হাজার দিরহাম বাজেটে তৈরি হলেও পরে এটি পুরোপুরি বিজ্ঞাপনরূপে পুনর্নির্মিত হয়, ১১টি ফ্লাইপাসসহ। এই ক্যাম্পেইনের ভিউ এখন ৩০ কোটির কাছাকাছি। বুত্রোস বলেন, ‘আজকের দিনে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবে আপনি কোটি কোটি ব্র্যান্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছেন। তাই আপনাকে সবার চেয়ে ভালো হতে হবে।’
এখন এমিরেটস ১৫০টির বেশি গন্তব্যে যায়। ইউরোমনিটর ইন্টারন্যাশনালের মতে, ২০২৩ সালে এক কোটি ৭০ লাখ আন্তর্জাতিক পর্যটক নিয়ে দুবাই ছিল বিশ্বের তৃতীয় সর্বাধিক পরিদর্শন করা শহর এবং একই বছর টানা দ্বিতীয় বছরের জন্য ট্রিপ অ্যাডভাইজার ট্রাভেলার্স চয়েস অ্যাওয়ার্ডসে দুবাই শীর্ষ বৈশ্বিক গন্তব্যের মুকুট লাভ করে।
সূত্র : খালিজ টাইমস।