মেলা রাঙাতে ব্যস্ত হলেও মৃৎশিল্পীদের জীবনে রং নেই

প্রথম নিউজ, অনলাইন: বৈশাখী উৎসব আর মেলার জন্য নানা ধরনের মাটির তৈজসপত্র আর খেলনা বানাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন পালপাড়ার মৃৎশিল্পীরা। মানুষের জীবন রাঙাতে রাত-দিন কাজ করছেন তারা। কিন্তু তাদের জীবনমানে নেই উন্নতি। উৎসব রাঙাতে নানা সামগ্রী রঙিন করে তুললেও এদের জীবন রাঙাতে নেই কারো উদ্যোগ।
নড়াইলের লোহাগড়ার কুন্দসী পালপাড়ার কুমাররা কাজে ব্যস্ত। ভোর ৫টা থেকে চাকা ঘুরিয়ে মাটির তৈরি কলসের ওপরের অংশ বানাচ্ছেন প্রভাষ পাল। আর স্ত্রী লক্ষ্মীরানী পাল মাটি পিটিয়ে বানাচ্ছেন সেই কলসের নিচের অংশ। পুরো উঠানজুড়ে সেগুলো রোদে শুকানো হচ্ছে।
চাকা ঘুরিয়ে তৈরি হচ্ছে মাটির কলসি, হাড়ি, ঢাকনা আর নানা ধরনের মাটির তৈজসপত্র। রীতি অনুযায়ী বৈশাখ মাসজুড়ে ঘুরবে না চাকা, তাই এই ব্যস্ততা।
প্রভাস পাল বলেন, ‘১১ মাস আমরা চাকা ঘুরাই, কিন্তু বৈশাখ মাসে চাকা ঘোরানো নিষেধ। আমরা তা মেনে চলি।
তাই চৈত্র মাসের এই কয় দিন হাতের সব কাজ শেষ করছি, মেলার প্রস্তুতি তো আছেই।’
জেলার রাধানগর, কুমোরডাঙ্গা, দলজিতপুর, রতডাঙ্গা, রায়গ্রাম, মুলিয়াসহ শত শত এলাকায় কুমারদের এখন ব্যস্ততার শেষ নেই। কোথাও চাকা ঘুরিয়ে তৈরি করা হচ্ছে নানা ধরনের সামগ্রী, কোথাও আবার চলছে মাটির মেমপুতুল, হাতি, ঘোড়া, নানা ধরনের মাটির ব্যাংক। কোনটি চাকায় ঘুরিয়ে আবার কোনটি হাতের ছাঁচে, আবার কোনটি হাতে তৈরি হয়। বাড়ির ছেলে-মেয়ে-বুড়ো সবাই ব্যস্ত হয়েছে বৈশাখী উৎসব রাঙাতে।
এগুলো বিভিন্ন মেলায় তোলা হবে।
কুমোরডাঙ্গা গ্রামে এখন চলছে নানা ধরনের মাটির খেলনায় রঙের কাজ। বাড়ির বৌ, ছেলে-মেয়ে সবাই বারান্দায় বসে নিজের মতো রং করছে, কোনটা সবুজ, কোনটা লাল আবার কোনটা হলুদ। পাশের বাড়িতে চলছে মাটির মেম পুতুলের গায়ে রং করা।
কোথাও মাসব্যাপী মেলা, আবার কোথাও চৈত্রসংক্রান্তি থেকেই শুরু হয়েছে নানা ধরনের উৎসব। বৈশাখের এই সব মেলা আর উৎসব রাঙ্গাতে মাটির তৈরি খেলনা একটি বড় জায়গা দখল করে আছে। গ্রামীণ জীবনে শিশুদের প্রধান পছন্দ হলো মাটির খেলনা। গ্রাম্য মেলার সেসব মাটির তৈজসপত্র খেলনা তৈরিতে ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছে নড়াইরের বিভিন্ন এলাকার পালপাড়ার মেয়ে-বধূরা। শেষ মুহূর্তে রং করে রঙিন করা হচ্ছে মাটির হাতি, ঘোড়া, মেম, বধূসহ নানা ধরনের পুতুল আর আম, কাঠালসহ নানা কারুকাজে মাটির তৈরি নানা ধরনের ব্যাংক।
চৈত্র মাসজুড়েই মহাব্যস্ত থাকেন নড়াইলের কুমোর পল্লির মৃৎশিল্পীরা। এ সময় পালবাড়ীর সবাই মিলে এসব সামগ্রী তৈরি করেন বৈশাখি মেলার জন্য। মাটি এনে ভিজিয়ে মোলায়েম করে তা দিয়ে কোনটি চাকায় ঘুরিয়ে আবার কোনটি হাতের ছাঁচে তৈরি হয় নানা ধরনের খেলনা। এরপর ছুরি দিয়ে ছেঁচে সঠিক আকৃতিতে এনে শুকিয়ে তার ওপর আবার অ্যারারুট পানির প্রলেপ দিয়ে মজবুত করে আবার শুকিয়ে পোড়ানো হয় চুল্লিতে। পোড়ানো খেলনার উপর নানা ধরনের রং, কোনটি এক রঙের আবার কোনটি একাধিক রঙের শেড দিয়ে রাঙ্গাতে হয়। বড় খেলনা, ব্যাংক আর ফলের গায়ে স্প্রে দিয়ে নিজের মনের মতো রাঙান শিল্পীরা। রং শুকিয়ে গেলে বাজারজাত করা হয়। এতগুলো ধাপ পেরিয়ে কোনটি পাঁচ টাকা ১০ টাকা, আকারে বড় হলে ২০-৩০ টাকায় বিক্রি হয়। আবার বড় পটারী আকারের খেলনা ২০০-৫০০ টাকায় বিক্রি হয়।
কুন্দসী পাল বাড়ির এইচএসসি পরীক্ষার্থী পিয়া পাল সবার সঙ্গে মাটির টিয়াপাখিতে একমনে রং করছেন। একপাশে মা আর অন্যপাশে তিনি। বৃষ্টিতে খেলনা শুকাতে সময় লেগেছে তাই দ্রুত কাজ শেষ করতে পরিবারের সবার সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন তিনি।
পিয়া পাল বলেন, পরীক্ষার মাঝে বাড়িতে মা-বাবাকে সাহায্য করছি,এর মধ্যে অন্যরকম আনন্দ,এটাই আমাদের পহেলা বৈশাখ,নতুন জামা কিংবা ভালো খাবার কোথায় পাবো।
পাল পাড়ায় বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বছরের অন্য সময় এসব মাটির সামগ্রী তেমন একটা বিক্রি হয় না, তাই এক প্রকার মাটির সামগ্রী তৈরির কাজ ছেড়েই দিয়েছেন কুমাররা। মাটির কলস কিংবা ঘটের মতো গোল বস্তু তৈরিতে চাকা লাগে, অধিকাংশ পালরা পেশা পরিবর্তন করায় পাল বাড়িতে চাকা খুবই কম। প্লাস্টিক, মেলামাইনসহ বিভিন্ন পণ্যের আগ্রাসনে হারিয়ে যেতে বসেছে মাটির তৈরি এই সব সামগ্রী।
নড়াইল সদরের দলজিৎপুর গ্রামের কার্তিক পাল বলেন, বাপ-দাদার পেশা তাই বাধ্য হয়েই কাজ করছি, আগে মাটি-কাঠ এগুলো ফ্রি পাওয়া যেত, এখন সবই কিনতে হয়। রঙের দামও বেড়েছে, এসব করে এখন আর কেউ টিকে থাকতে পারছে না। জীবন বাঁচানোই দায়।
পালপাড়ার শিশুদের জন্য নতুন বছরের জন্য নেই রঙিন জামা কিংবা বছরের প্রথম দিনের ভালো খাবারের আয়োজন। এরা মানুষের উৎসব রাঙ্গাতে নানা সামগ্রী রঙিন করে তুললেও এদের জীবন রাঙ্গাতে নেই কারো উদ্যোগ।
কুন্দসী পাল পাড়ার অর্পনা পাল বলেন, 'বৈশাখি মেলার জন্য কতকষ্ট করে সব খেলনায় রং করছি কিন্তু আমাদের জীবনে কোনো রং নেই। মেলায় বেচার জন্য মেমপুতুলের গায়ে লাল রং করছি, আমার ছোট্ট মেয়েটির জন্য বৈশাখের কোনো জামাই কেনা হয়নি।'
নড়াইলের মৃৎশিল্পীদের তালিকা থাকলেও এই শিল্পকে বাঁচাতে জেলা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের তেমন কোনো উদ্যোদ নেই।
আশার বানী শুনিয়ে নড়াইল ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) উপপরিচালক প্রকৌশলী সোলায়মান হোসেন বলেন, 'আমরা তাদের উন্নতমানের প্রশিক্ষণ দিতে পারি, ঋণ সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে মৃৎশিল্পীদের টিকিয়ে রাখতে পারি।'
হারিয়ে যেতে বসা মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রেখে বাঙালি সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখলেই উৎসব আরো রঙিন ও প্রাণবন্ত হবে এমনটাই প্রত্যাশা সবার।