বছরের প্রথম দিনেই উৎসব, সময় লাগবে সব বই পেতে
ফেব্রুয়ারির আগে সম্ভব নয় বলছেন প্রেস মালিকরা, >অষ্টম-নবমের ৪ বইয়ের ডামির অপেক্ষায় ছাপাখানা
প্রথম নিউজ, ঢাকা: নতুন বই ছাপানো নিয়ে এখনও লেজেগোবরে অবস্থায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের তৎপরতা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে হবে ভোটকেন্দ্র। নির্বাচনী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন শিক্ষকরা। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, বছরের প্রথম দিনে এবার কি শিক্ষার্থীরা নতুন বই উৎসব থেকে বঞ্চিত হবে?
সেই প্রশ্নের উত্তরে ২৬ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে খোদ শিক্ষামন্ত্রী জানান, নির্বাচনের কারণে বই উৎসবটা এবার ১০-১১ তারিখেও হতে পারে। এ নিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষাবিদরা অসন্তুষ্টির সুরে প্রতিক্রিয়া জানান। এনসিটিবি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে দেখা দেয় ‘অস্বস্তি’। তবে সব সংশয়-অস্বস্তি পেছনে ফেলে ১ জানুয়ারিই বই উৎসব করার পথে হাঁটছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পাঠ্যপুস্তক বোর্ডসহ সংশ্লিষ্টরা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বছরের প্রথম দিনে বই উৎসব সরকারের বড় সাফল্যের একটি। এ ধারায় ছেদ পড়তে দেওয়া যাবে না। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও জাতীয় নির্বাচনের তৎপরতার ফাঁকে ১ জানুয়ারিই বই উৎসব উদ্বোধন করার জোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বই লেখা, ছাপানো এবং উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহ করাটা আমাদের কাজ। বই উৎসব কবে হবে, তা ঠিক করে সরকার। তবে অংশীজন হিসেবে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আমাদের সবসময় যোগাযোগ থাকে, বৈঠক হয়। এ পর্যন্ত আমার কাছে যতটুকু তথ্য, তা হলো, প্রতি বছর ১ জানুয়ারি বই উৎসব হয়, এবারও সেটাই হবে বলেই জানি। এর ব্যতিক্রম কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কি না, সেটা আমরা জানি না।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক-১ শাখার একজন উপসচিব জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা নিয়ে অস্পষ্টতা ছিল। বই ছাপানোও শেষ হয়নি বলে জানিয়েছিল পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। তবে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনায় ১ তারিখেই (জানুয়ারি) বই উৎসব করার প্রস্তুতি চলছে। বড় কোনো ঝামেলা না হলে বছরের প্রথম দিনে এটা শুরু হবে।’
তবে এ নিয়ে ‘আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত’ হয়নি বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের মাধ্যমিক-১ শাখার অতিরিক্ত সচিব খালেদা আক্তার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘১ জানুয়ারিই তো বই উৎসব হয়। এটা যদি কোনো কারণে পিছিয়ে যায়, তখন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আমরা জানাবো। যেহেতু তেমন কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়নি, সেজন্য ১ তারিখে হবে ধরেই কাজ করছেন সবাই।’
বই উৎসব ১ জানুয়ারি শুরু হলেও সব বই সেদিন পাবে না শিক্ষার্থীরা। এমনকি নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে কোনো বই নাও দেওয়া হতে পারে প্রথম দিন। অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ১০-১২ তারিখে বই পেতে পারে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে চলতি ডিসেম্বর মাসের বাকি ১৯ দিনে বই ছাপানোর কাজ কতটা গুছিয়ে উঠতে পারছে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানান, জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে হয়তো ক্লাস শুরু হতে পারে। ক্লাস শুরুর আগেই তারা ধাপে ধাপে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দিতে চান।
এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, বই তো সব একদিনে হাতে তুলে দেওয়াটাও কঠিন। এটা নিয়ে অযাচিত সমালোচনা দেখি আমরা অনেক সময়। বিষয়টি বুঝতে হবে। কয়েকদিনের মধ্যেই কিন্তু সব শিক্ষার্থী শতভাগ বই পেয়ে যায়। শুধু সমালোচনা করার অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত।
এ প্রসঙ্গে এনসিটিবি চেয়ারম্যান ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘ধাপে ধাপে বই দেওয়াটা তো এবারই প্রথম না। সব বই জানুয়ারির ১ তারিখে দিতে হবে এটাও কোনো নির্দেশনায় নেই। ওইদিন আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করলাম। একটু সময় নিয়ে হলেও সঠিকভাবে বই বিতরণ করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি।’
২০২৪ শিক্ষাবর্ষের জন্য ৩০ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার ৫১৭টি পাঠ্যবই ও শিক্ষক সহায়িকা ছাপাচ্ছে এনসিটিবি। চলতি বছরের শুরুতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, বছরের শেষে নির্বাচন। এজন্য এবার অন্য বছরের চেয়ে অন্তত দুই মাস আগে বই ছাপানোর কাজ শুরু করা হবে। তবে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যায়নি। নতুন শিক্ষাক্রমের বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি, ত্রুটি-বিচ্যুতি এড়াতে দফায় দফায় রিভিশন, বই ছাপানোর চুক্তিতে অনিয়ম, মুদ্রণশিল্প সমিতির সঙ্গে এনসিটিবির বিরোধসহ নানা কারণে বছরের শেষে এসে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে।
পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সূত্র জানায়, ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী সংখ্যা ধরা হয়েছে তিন কোটি ৮১ লাখ ২৭ হাজার ৬৩০ জন। তাদের জন্য বই ছাপা হচ্ছে মোট ৩০ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার ৫১৭টি। প্রথম, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ছাপানো হয়েছে ৫ কোটি ৩৮ লাখ ৩ হাজার ৪২৩ কপি বই। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বই সংখ্যা ৩ কোটি ৩৬ লাখ ১ হাজার ২৭৪টি। প্রাক-প্রাথমিকের জন্য ৬১ লাখ ৯৩ হাজার ৮৭৮ কপি বই ছাপা হয়েছে।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে ছয় কোটি ৪৫ লাখ ৪৮ হাজার ৩০৮ কপি, সপ্তম শ্রেণির চার কোটি ৪৫ লাখ ৫৭ হাজার কপি, অষ্টম শ্রেণির জন্য পাঁচ কোটি ৩৪ লাখ ৮৪ হাজার ২৭১ কপি এবং নবম শ্রেণির জন্য পাঁচ কোটি ছয় লাখ ৮৪ হাজার ৫৭৩ কপি বই ছাপা হচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর (পাঁচটি ভাষায় রচিত) শিশুদের জন্য এবার মোট দুই লাখ পাঁচ হাজার ৩১ কপি বই ছাপা হচ্ছে। অন্য বইয়ের মধ্যে পাঁচ হাজার ৭৫২ কপি ‘ব্রেইল’ বই ছাপা হবে। তাছাড়া শিক্ষকদের ৪০ লাখ ৯৬ হাজার ৬২৮টি ‘শিক্ষক সহায়িকা’ দেওয়া হবে।
ছাপাখানার মালিক ও এনসিটিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ১৮ কোটির কিছু বেশি বই ছাপা হয়েছে। বাকি রয়েছে এখনো ১২ কোটি বই। চলতি ডিসেম্বরে সর্বসাকুল্যে আরও ৫ কোটি বই ছাপানোর কাজ শেষ হতে পারে। বাকি সাড়ে ৬ থেকে ৭ কোটি বই ছাপাতে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
আরআর প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের প্রোপ্রিয়েটর ও বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রাথমিক ও ষষ্ঠ-সপ্তমের বই নিয়ে সমস্যা নেই। মুশকিলটা হয়ে গেছে অষ্টম-নবমের বই নিয়ে। অষ্টমের বই কিছুটা এগোলেও নবমের বই পেতে বহু দেরি। চুক্তি অনুযায়ী—২৫ জানুয়ারির মধ্যে নবমের বই ডেলিভারি দেওয়ার কথা রয়েছে আমাদের। সেটা করলেও তো উপজেলা বই পৌঁছাতে ফেব্রুয়ারি। ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হয়তো নবমের সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে থাকবে।’
ছাপাখানায় যায়নি ৪টি বইয়ের ডামি
১ জানুয়ারি বই উৎসবের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বললেও এখনো অষ্টম ও নবম শ্রেণির চারটি বইয়ের ডামি ছাপাখানায় দিতে পারেনি পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। এরমধ্যে নবম শ্রেণির তিনটি এবং অষ্টমের একটি বই। ছাপাখানায় ডামি দিতে না পারা নবম তিনটি বই হলো, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, বিজ্ঞান অনুশীলন এবং বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ। আর অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ডামি এখনো ছাপাখানায় দেয়নি এনসিটিবি। ফলে এ চারটি বই ছাপানো ঝুলে আছে। ছাপাখানার মালিক ও এনসিটিবি কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন।
তাদের তথ্যানুযায়ী, নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী নবম শ্রেণিতে এবার ১০টি বিষয়ে ১১টি বই। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সংখ্যার হিসাবে প্রতিটি বিষয়ের জন্য ৪৬ লাখের বেশি বই ছাপতে হবে। হিসাব অনুযায়ী, শুধু নবম শ্রেণির বই হবে পাঁচ কোটি ছয় লাখ ৮৪ হাজার। যে তিনটি বইয়ের ডামি এখনও ছাপাখানায় যায়নি, সেগুলোর বই সংখ্যা হবে প্রায় দেড় লাখ।
অন্যদিকে, অষ্টম শ্রেণিতেও ১০টি বিষয়ে ১১টি বই। সারাদেশে অষ্টমের শিক্ষার্থী সংখ্যা ধরা হয়েছে সাড়ে ৪৮ লাখের কিছু বেশি। অর্থাৎ এ শ্রেণির প্রতিটি বইয়ের কপি ছাপতে হবে সাড়ে ৪৮ লাখ করে। ১০টি বিষয়ে ১১টি বই হওয়ায় অষ্টমের মোট বই সংখ্যা দাঁড়াবে পাঁচ কোটি ৩৪ লাখ ৮৪ হাজার।
এ প্রসঙ্গে আরআর প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের প্রোপ্রিয়েটর ও বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘ডামি না দিলে বই ছাপাবো কীভাবে? আমাদের সঙ্গে নবমের বই ছাপানোর চুক্তি দেরিতে করেছে এনসিটিবি। নবমের তিনটি ডামি বই এবং অষ্টমের একটি তারা দিচ্ছেন না। কবে দেবেন, সেটাও জানাননি।’
জানতে চাইলে এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তক ইউনিটের সদস্য অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, ‘ডামি বই দেখার কাজ চলছে। ত্রুটি-বিচ্যুতি যাচাই করা হচ্ছে, যাতে ছাপার পর কোনো বিড়ম্বনায় পড়তে না হয়। দ্রুত আমরা চারটি ডামি বই ছাপাখানায় পাঠাবো।’