পাসপোর্ট করানো যাচ্ছে না ঢাকার শিশুদের
ডিএসসিসির জন্মসনদ ভোগান্তি
প্রথম নিউজ, ঢাকা: চাকরিতে যোগদান, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ নাগরিক সেবার ১৯টি ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধন সনদ প্রয়োজন হয়। সে কারণে এখন পদে পদে ব্যবহার হচ্ছে জন্মসনদ। গত কয়েকমাস ধরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) থেকে এ গুরুত্বপূর্ণ সনদ হাতে পেয়েও কেউ কাজে লাগাতে পারছেন না। এটি শুধু শিশুর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির কাজে ব্যবহার করা যাচ্ছে। সম্ভব হচ্ছে না পাসপোর্ট করানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজও।
গত বছর (২০২৩) প্রায় তিন মাস (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় জন্ম নেওয়া শিশুদের জন্মসনদ প্রদান কার্যক্রম। পরে গত অক্টোবর মাসে নিজস্ব সার্ভার চালু করে জন্মনিবন্ধন সেবা দিতে শুরু করে ডিএসসিসি। ওই মাসেই জন্মনিবন্ধন করানো হয় প্রায় ৭ হাজার, নভেম্বর মাসে ১৫ হাজারের বেশি জন্মনিবন্ধন দেয়, পরে ডিসেম্বর মাসে প্রায় ২০ হাজার জনের জন্মসনদ দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এর পর থেকে প্রতি মাসে বিপুল সংখ্যক জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। নিজস্ব সার্ভারের মাধ্যমে জন্মনিবন্ধন সনদ দিলেও সেই জন্মসনদ দিয়ে শুধু স্কুলে ভর্তি করানো যাচ্ছে শিশুদের। বাকি কোনো কাজ করা যাচ্ছে না। ডিএসসিসির নিজস্ব সার্ভারের সঙ্গে অন্যান্য সেবাকেন্দ্রিক সার্ভারের সংযোগ না থাকায় এ ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে মানুষকে।
এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে প্রায় ২৬টি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন যাতে যেন পাসপোর্ট বা এ জাতীয় সেবা পেতে কোনো ধরনের সমস্যা না হয়। কিন্তু সেই সার্ভারগুলো এখনো ডিএসসিসির নিজস্ব সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত হয়নি।
রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান। তার দুই বছরের ছেলে রিহান আহমেদের জন্মনিবন্ধন করা হয়েছে বেশ কিছুদিন আগেই। তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল ২ এর বাসিন্দা হওয়ার কারণে সেই আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে খুব সহজেই জন্মসনদ নিতে পেরেছেন। কিন্তু সমস্যা বাঁধে অন্য জায়গায়। এ জন্মসনদ দিয়ে পাসপোর্ট করাতে গিয়েই তাকে পড়তে হয়েছে বিড়ম্বনায়। কারণ পাসপোর্টের সার্ভারের সঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জন্মসনদ দেওয়ার সার্ভার সংযুক্ত নয়। সে কারণে পাসপোর্ট অফিস থেকে বারবার চেষ্টা করার পরেও তার জন্মনিবন্ধনটি সঠিক দেখাচ্ছিল না।
মিজানুর রহমান বলেন, জরুরি প্রয়োজনে যখন পাসপোর্ট অফিসে বাচ্চার পাসপোর্টের জন্য জন্মনিবন্ধন দিলাম। তখন তারা দেখে বললেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সার্ভারের সঙ্গে তাদের সার্ভারের কোনো সংযোগ নেই। তাই ডিএসসিসির সার্ভারের মাধ্যমে করা জন্মনিবন্ধন দিয়ে এখন পাসপোর্ট করানো সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে পরে জানতে পারলাম যে, ডিএসসিসির নিজস্ব সার্ভারে জন্মনিবন্ধন নিজেরাই প্রদান করছে। অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের সার্ভারের ইন্টারনাল কানেক্টিভিটি এখনো তৈরি করতে পারেনি। ফলে ডিএসসিসির দেওয়া জন্মসনদ দিয়ে শিশুদের পাসপোর্ট করানো যাচ্ছে না।
এ সমস্যা নিয়ে ঢাকার একটি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে যোগাযোগ করা হলে সেখানকার কর্মরত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শুধু ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন থেকে করানো জন্মসনদ দিয়ে পাসপোর্ট করানোর ক্ষেত্রে এ সমস্যাটি হচ্ছে। কারণ তারা পাসপোর্টের মতো সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তাদের সার্ভারের কানেক্টিভিটি করাতে পারেনি। এটা সমাধান হতে আরও সময় লাগবে। যতদিন পর্যন্ত এর সমাধান না হবে ততদিন পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব সার্ভারের মাধ্যমে জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে পাসপোর্ট করানো সম্ভব হবে না। তবে আবার যদি সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঢাকার দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন সার্ভারের সংযোগ স্থাপন করা হয় তাহলে এই জন্ম সনদ দিয়েই ফের শিশুদের পাসপোর্ট করানো যাবে।
তিনি আরও বলেন, আপনার সন্তানের পাসপোর্ট করা যদি খুবই জরুরি হয়ে থাকে তাহলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ছাড়া অন্য যেকোনো স্থান থেকে জন্মনিবন্ধন করে নিয়ে পাসপোর্ট করতে হবে। এছাড়া অন্য কোনো উপায় দেখছি না।
সার্বিক বিষয় নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মুখপাত্র আবু নাসের বলেন, সমস্যা হচ্ছে সেটা আমরাও ইতোমধ্যে জেনেছি। এ বিষয়টির সমাধানের লক্ষ্যে আমাদের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর, প্রতিষ্ঠানকে আমরা চিঠি পাঠিয়েছি। সার্ভারের মাধ্যমে অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যে কানেকশন এটি ঠিক করার লক্ষ্যেই আমরা এসব প্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠিয়েছি। আশা করা যাচ্ছে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যেই এই বিষয়ে সমাধান পাওয়া যাবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবে জন্মনিবন্ধনের জটিলতা দেখা দেওয়ায় আমরা নিজস্ব সার্ভারে জন্মনিবন্ধনের কাজ শুরু করেছি। আমাদের লক্ষ্যই হলো এখানে যেন জনভোগান্তি না হয়। কিন্তু জন্মনিবন্ধন সার্ভারের সঙ্গে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সার্ভার কানেক্ট করানোর জন্য সেই সব প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা ইতোমধ্যে চিঠি দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের নিজস্ব সার্ভারে হওয়ার কারণে কোনো আবেদনে ভুল হলে অনলাইনে ঢুকেই সংশোধন করা যাবে ফলে নাগরিকদের ভোগান্তি অনেকটা কমে এসেছে। এর আগে আবেদনকারীর যদি কোনো ভুল হতো তাহলে তা সংশোধনের জন্য নতুন করে আবার আবেদন করতে হতো। এছাড়া আগে জন্মসনদ পেতে যেমন ভোগান্তি পোহাতে হতো, সবাইকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হতো, সার্ভার থাকত না— এখন এই ধরনের সমস্যার সমাধান আমাদের হয়েছে। আমরা এখন খুব সহজেই ভোগান্তিহীন ভাবে দ্রুত জন্মসনদ প্রদান করতে পারি। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সার্ভারকেন্দ্রিক সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে এ সমস্যাটার সমাধান হয়ে গেলে জন্মনিবন্ধনকেন্দ্রিক আর কোনো জটিলতা থাকবে না।
গত বছর (২০২৩) মূলত জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের ফি সিটি কর্পোরেশন পাবে নাকি সরাসরি সরকারি কোষাগারে জমা হবে– এ নিয়ে তৈরি হয়েছিল সমস্যা। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ফি পরিশোধে সম্প্রতি ই-পেমেন্ট ব্যবস্থা চালু করে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, যার ফলে এই ফি সরাসরি চলে যাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। এ কারণেই বন্ধ করে রাখা হয়েছিল দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জন্মনিবন্ধন সেবা।
দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, লোকবল, সনদের জন্য খরচ, প্রিন্টিং খরচ, কার্যালয়ের খরচ– সবমিলিয়ে এ খাতে তাদের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। তবু সিটি কর্পোরেশন সব কাজ করবে কিন্তু ফি তাদের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে যাবে এটি তারা মেনে নেয়নি। এ নিয়ে সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালি চলেছে অনেকদিন। ফলে সেই সময় ৩ মাসেরও বেশি সময় ধরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে বন্ধ ছিল জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম।
পরে এ সমস্যার সমাধান হয়, জন্মসনদপ্রাপ্তি নিশ্চিত হয়েছে নাগরিকদের, কিন্তু সমস্যা থেকে গেছে অন্য জায়গায়। সমস্যাটি হলো জন্মনিবন্ধন থাকা সত্ত্বেও করা যাচ্ছে না পাসপোর্টসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ। জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের মূল কাজ করে রেজিস্টার জেনারেলের কার্যালয়। বিডিআরআইএস নামে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে গিয়ে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের কাজ করা হয়, যা পরিচালনা করে আসছে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, আর এই সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত আছে ১৬টি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নতুন সার্ভার, ওয়েবসাইট দিয়ে অনলাইন জন্মনিবন্ধন কাজ শুরু করে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে এ কারণে যে তাদের সার্ভার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। তারা শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছে। ফলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন থেকে নেওয়া জন্মসনদ দিয়ে ঢাকার শিশুদের শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির কাজে ব্যবহার করতে পারছে। বাকি অন্যান্য কাজ করানো যাচ্ছে না।
অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১ থেকে ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড পর্যন্ত পুরাতন ওয়ার্ডগুলোতে কাউন্সিলর অফিসের মাধ্যমেই জন্মনিবন্ধন সনদ গ্রহণ করা যাচ্ছে। তারা নিজস্ব সার্ভারে না গিয়ে আগের মতোই জন্ম-মৃত্যু রেজিস্টার জেনারেল কার্যালয়ের নিজস্ব অর্থাৎ আগের ওয়েবসাইট থেকেই তারা জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন প্রক্রিয়ার কাজ সম্পন্ন করছে। তবে গ্রাহক সেবা বাড়াতে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। ওয়ার্ডগুলোতে বসবাসরতদের ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে জন্মনিবন্ধন সনদ গ্রহণ করতে হচ্ছে। ১ থেকে ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড পর্যন্ত পুরাতন ওয়ার্ডগুলোতে কাউন্সিলর অফিসের মাধ্যমেই জন্মসনদ গ্রহণ করা যাচ্ছে।
তবে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩৭ থেকে ৫৪ নম্বর পর্যন্ত ওয়ার্ডগুলোতে কাউন্সিলরদের সচিবের পদ শূন্য থাকায় সেখানে নিবন্ধক এখনো দেওয়া হয়নি। ফলে এসব ওয়ার্ডগুলোর বাসিন্দাদের তাদের সন্তানের জন্মনিবন্ধনের জন্য এসব আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে যেতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মুখপাত্র মকবুল হোসাইন বলেন, জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কোনো এলাকায় এমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। জন্ম-মৃত্যু রেজিস্টার জেনারেল কার্যালয়ের পক্ষ থেকে সার্ভারের যে সমস্যা হয় সেগুলো ছাড়া আমাদের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সেবার কোনো সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না। সব এলাকার বাসিন্দারাই নিজ নিজ ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় গিয়ে তাদের সন্তানদের জন্মনিবন্ধন করিয়ে নিতে পারছেন। এছাড়া নতুন ওয়ার্ডগুলোর নাগরিকরা তাদের সন্তানদের জন্মনিবন্ধন সেবা নিতে স্থানীয় আঞ্চলিক কার্যালয়ে গিয়ে সেবা গ্রহণ করতে পারছেন।
উল্লেখ্য, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে স্কুলে ভর্তি, জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি, পাসপোর্ট তৈরিসহ মোট ১৮টি সেবা পেতে জাতীয় জন্মসনদ প্রয়োজন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সরকারি বেসরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ভোটার তালিকা, জমি রেজিস্ট্রেশন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, আমদানি-রপ্তানি, লাইসেন্স ইস্যু, গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ, টেলিফোন সংযোগগ্রহণ, বাড়ির নকশার অনুমোদন, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুসহ নানান কাজে ব্যবহৃত হয় জন্মসনদ।