প্রভোস্ট-হাউস টিউটরের অবহেলার প্রমাণ মিলেছে, নির্দেশদাতা অন্তরা
হাইকোর্টে তদন্ত প্রতিবেদন
প্রথম নিউজ, অনলাইন: কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) ছাত্রী হলে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে হলের প্রভোস্ট শামসুল আলম, হাউস টিউটর মৌমিতা আক্তার, ইশরাত জাহানসহ কয়েকজনের দায়িত্বে চরম অবহেলা পেয়েছে আদালতের নির্দেশে গঠিত তিন সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি। এ ছাড়া, প্রক্টর শাহাদাত হোসেনের কর্মকাণ্ড উদাসীন ও দায়সারা গোছের বলেও প্রতিবেদনে এসেছে। মঙ্গলবার ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায় বিচার বিভাগীয় প্রতিবেদন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন। প্রতিবেদন দু’টি উপস্থাপনের পর বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ আদেশের জন্য বুধবার দিন রাখেন। একইসঙ্গে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত আইন ও বিধি সংগ্রহ করতে এবং ইবি’র কোনো আইনজীবী থাকলে তাকে জানাতে বলা হয়েছে। আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন রিটকারী আইনজীবী গাজী মো. মহসীন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইবি’র দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ওই ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনায় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে পৃথক তদন্ত কমিটি। পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী সানজিদা চৌধুরী ফুলপরিকে র্যাগিং, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নির্দেশদাতা এবং ওই পাশবিক, অমানবিক ও ন্যক্কারজনক ঘটনা সংঘটনের হুকুমদাতা। ওই অমানবিক, পাশবিক, ন্যক্কারজনক, জঘন্য ঘটনার সঙ্গে হালিমা আক্তার মুন্নী, ইশরাত জাহান মীম, তাবাসসুম ইসলাম, ময়াবিয়া জাহান জড়িত এবং তাদের দ্বারা ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে। তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে ফুলপরিকে পাশবিক কায়দায় অমানবিকভাবে নির্যাতন করেন।
ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত বলে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এসেছে। এতে আরও বলা হয়, সরাসরি নির্যাতন করেন হালিমা আক্তার মুন্নী, ইশরাত জাহান মীম, তাবাসসুম ইসলাম ও ময়াবিয়া। তাবাসসুমের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে প্রতীয়মান হয় যে, ১২ই ফেব্রুয়ারি রাতে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের ডাইনিংয়ে ফুলপরির ওপর পাশবিক নির্যাতনের সময় ঊর্মি ও মীম ভিডিও ধারণ করেন। তবে কোনো ভিডিও রেকর্ড পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া গণরুমে উপস্থিত ছাত্রীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আল আমিন কর্তৃক ফুলপরিকে হুমকি দেয়ার বিষয়টির সত্যতা পাওয়া গেছে।
প্রভোস্টদের গাফিলতি, প্রক্টরের উদাসীনতা: তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, ২০শে ফেব্রুয়ারি ফুলপরির জবানবন্দি গ্রহণের সময় তার বাঁ গালে কালো দাগ দেখা যায় বলে প্রতিবেদনে এসেছে। প্রতিবেদনের ভাষ্য, হলের প্রভোস্ট শামসুল আলম, সহকারী রেজিস্ট্রার আবদুর রাজ্জাক, শাখার কর্মকর্তা হামিদা খাতুন, আয়া, ডাইনিং ম্যানেজার সোহেল রানা, হাউস টিউটর মৌমিতা আক্তার ও সহকারী অধ্যাপক ইশরাত জাহানের দায়িত্বে চরম অবহেলা ও ফুলপরি ইস্যুতে গাফিলতি ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। এ ছাড়া প্রক্টর শাহাদাত হোসেনের কর্মকাণ্ড উদাসীন ও দায়সারা গোছের বলে প্রতিবেদনে এসেছে। তদন্ত কমিটির ভাষ্য, তাবাসসুম ফুলপরিকে ৮ই ফেব্রুয়ারি দেখা করতে বলেন। ১০ই ফেব্রুয়ারি রাতে দেখা করে। তাবাসসুম এটিকে বেয়াদবি হিসেবে মনে করেন। এ কারণে তাবাসসুম ব্যক্তিগতভাবে ফুলপরির ওপর রাগান্বিত হন। এটিই তাবাসসুম প্রচার করেন, ফুলপরি সিনিয়রদের সঙ্গে বেয়াদবি করেছেন। এ থেকে ঘটনার সূত্রপাত হয়। তাবাসসুমের নেতৃত্বে ১০৫ নম্বর রুমে পিংকীর উপস্থিতিতে ফুলপরিকে ১১ই ফেব্রুয়ারি রাত আটটায় অন্য মেয়েদের উপস্থিতিতে গণরুমে হেনস্তা করা হয়। আজেবাজে কথা বলা হয়।
পরবর্তী সময়ে অন্তরার উপস্থিতিতে রাত নয়টার দিকে ৩০৬ রুমে নিয়ে ফুলপরিকে মেয়েদের সামনে জিজ্ঞাসাবাদ, গালিগালাজ এবং আজেবাজে কথা বলে মানসিক নির্যাতন করা হয়। এমনকি সেই রাতে ৩০৬ নম্বর রুমে থাকা মেয়েদের প্রত্যেককে ফুলপরিকে একটা করে চড় মারতে নির্দেশ দেন অন্তরা। ফুলপরির মুঠোফোন কেড়ে নেন লিমা ও তাবাসসুম। নির্যাতনের একপর্যায়ে ফুলপরি অন্তরার পা ধরতে বাধ্য হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফুলপরি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। অন্তরার নির্দেশে তাকে পাহারা দিয়ে রাখা হয়। পরে অন্তরার জোরজবরদস্তির কারণে প্রভোস্ট ফুলপরিকে হল ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এরপর প্রভোস্ট হলে উপস্থিত থাকা অবস্থায়ই অন্তরা, তাবাসসুম, মীম, ঊর্মি, ময়াবিয়াসহ অন্যান্য মেয়েরা ফুলপরিকে হাত ধরে টানাটানি করে হেনস্তা করেন। পরে ফুলপরিকে প্রভোস্ট শামসুল আলম বরাবর মুচলেকা দিতে বাধ্য করা হয়।
এর আগে গত ১২ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ করেন ফিন্যান্স বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ফুলপরি খাতুন। এ ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন যুক্ত করে এবং জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা চেয়ে ১৫ই ফেব্রুয়ারি রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইবি’র সাবেক শিক্ষার্থী গাজী মো. মহসীন।
মামলার প্রস্তুতি ফুলপরির: কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতিত ছাত্রী মোছাঃ ফুলপরি খাতুন মামলা করতে কুষ্টিয়া আদালতের আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। ইবি শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে এই মামলা করা হবে। গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টায় এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন আইনজীবী পি এম সিরাজুল ইসলাম। তিনি জানান, বিভিন্ন তদন্ত কমিটির তদন্তে ফুলপরি খাতুনকে মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়। তিনি ৭/৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করবেন। গতকাল বিকালে আমার কাছে মামলার বিষয়ে কথা বলতে এসেছিলেন। আমি মামলাটি রেডি করে ফোন দিলে ফুলপরি এসে ওকালত নামায় সই করবেন। আশা করি আগামী সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট আদালতে মামলা দায়ের সম্ভব হবে।
এ সময় উপস্থিত সাংবাদিকদের ফুলপরি বলেন, আমি চাই তাদের ছাত্রত্ব বাতিল হোক। তাদের মতো ছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার অধিকার নেই। আমার সঙ্গে তারা যা করেছে এটা ফৌজদারি অপরাধ। আমি এর জন্য মামলা করতে চাই। তাড়াতাড়িই আমি মামলা করবো, যাতে এরকম আর কখনো না হয় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সেজন্য এর সর্বোচ্চ শাস্তি যেটা সেটা আমি আশা করি।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: