প্রকল্পের নামে ফসলি জমিতে বালু উত্তোলনের মহোৎসব
অবৈধ ড্রেজারে মাটি উত্তোলন আর বিক্রির ফলে তিন ফসলি জমি নষ্ট হওয়াসহ বর্ষা মৌসুমে এলাকায় ভাঙনের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
প্রথম নিউজ, টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার কাশিল ইউনিয়নের সায়ের ও নাকাছিম এলাকায় অননুমোদিত লেকভিউ প্রকল্পের নামে ফসলি জমিতে চলছে মাটি ও বালু বিক্রির ব্যবসা। অবৈধ ড্রেজারে মাটি উত্তোলন আর বিক্রির ফলে তিন ফসলি জমি নষ্ট হওয়াসহ বর্ষা মৌসুমে এলাকায় ভাঙনের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রভাবশালী নেতারা একাট্টা হয়ে এ ব্যবসা করছেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
সরেজমিন দেখা যায়, লেকভিউ প্রকল্পের কাজটি করছে বাদল এন্টারপ্রাইজ। কাজের অংশীদার বাদল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি কাজী শহিদুল ইসলামের ভাই কাজী বাদল, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও কাশিল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নাজমুল হুদা খান বাহাদুর ও উপজেলা কৃষক লীগের সহ-সভাপতি জহির আহমেদ পিন্টু। ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব পালনে রয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আতিকুর রহমান আতিক। সম্প্রতি লেকভিউ প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন করেন টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখীপুর) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম (ভিপি জোয়াহের)।
ভুক্তভোগীরা জানান, লেকভিউ প্রকল্পের নামে কাশিল ইউনিয়নের নাকাছিম ও সায়ের মৌজার শতাধিক একর তিন ফসলি জমির মাটি ২০-৩০ ফুট গভীর করে কেটে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হচ্ছে। দিনরাত মিলিয়ে চলছে পাঁচ শতাধিক ডাম্প ট্রাক। মাটিবাহী ২৫-৩০ টনের এসব ড্রাম ট্রাকের চাকায় নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ সড়ক। অপরিকল্পিতভাবে মাটি কাটার ফলে ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে পার্শ্ববর্তী বাঘিল গ্রামের মসজিদ ও কবরস্থান।
ভুক্তভোগী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অনুমতি ছাড়া জোর করে আমার ১৬ শতাংশ জমি কেটে নিয়েছেন বালু ব্যবসায়ীরা। ঈদের আগের দিন জমির দাম বাবদ আমাকে দুই লাখ টাকা দিয়েছেন কাজী বাদল। যদিও আমি প্রতি শতাংশ জমির দাম চেয়েছি ৪০ হাজার টাকা। দাম অনুযায়ী আমার পাওনা ছয় লাখ ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু তারা নির্ধারণ করেছেন প্রতি শতাংশ ২২ হাজার টাকা। তাদের হিসাব অনুযায়ী এখনো এক লাখ ৫২ হাজার টাকা বকেয়া রয়েছে আমার।’
তিনি বলেন, ‘আমার জমিগুলো তিন ফসলি। জমিটুকুতে আমি ধান আবাদ করতাম। নাকাছিম গ্রামের বাঙ্গি জেলার মধ্যে সেরা। এ গ্রামের জমিগুলোতে ধান, সরিষা, কাঁচামরিচসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি আবাদ করা হতো। এবছর আবাদ না হওয়ায় উপজেলায় সবজি ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ‘জমি কিনতে দালাল নিযুক্ত করেছেন কাজী বাদল। দালাল কোনটি কার জমি সেটি খুঁজে খুঁজে বের করাসহ বিক্রির ব্যবস্থা করছেন। নিরাপত্তাহীনতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করেন না,’ যোগ করেন ভুক্তভোগী রফিকুল ইসলাম।
ইউনুস মিয়া নামের আরেকজন বলেন, ‘শুনে আসছিলাম এখানে লেকভিউ নামে একটি বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। এটি শুনেই শুরুতে অনেকেই জমি বিক্রি করেছেন। এখন দেখছি শুধু মাটি খনন আর বিক্রি করা হচ্ছে। প্রথমে ১০-১৫ ফুট ভেকু মেশিন দিয়ে জমি কাটলেও এখন বালু উত্তোলনের জন্য ড্রেজার ব্যবহার করা হচ্ছে। ড্রেজার দিয়ে ৩০-৫০ ফুট গভীর থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করছে। পাশের জমি ভাঙতে শুরু করেছে। গ্রামের মসজিদ, কবরস্থানসহ আবাদি জমি ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।’
স্থানীয় দেলখুশ মিয়া বলেন, ‘ধান, সরিষা, রসুন, করলা, মিষ্টি কুমড়া, বাঙ্গিসহ নানা ধরনের শস্য আবাদ হয় গ্রামগুলোতে। নাকাছিম গ্রামের এক পাকি (৩৫ শতক) জমিতে আবাদ করে সারা বছর নিশ্চিন্তে খেতে পারেন কৃষকরা। গ্রামগুলোর প্রতিটি জমিই তিন ফসলি। মাটি ব্যবসায়ীরা জমিগুলো কেটে বালু বের করে ফেলেছেন। ইউনিয়নের বাঘিল নয়াপাড়া গ্রামের মনিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ড্রেজার দিয়ে ৩০ ফুট গভীর থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এর প্রভাবে ২০০ থেকে তার অধিক দূরত্বের জমি ধসে পড়ছে। কিছু টাকা দিয়ে আবার টাকা না দিয়েই ওই জমিগুলো কাটা হচ্ছে।’
জানতে চাইলে কথিত লেকভিউ প্রকল্পে অংশীদার হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন উপজেলা কৃষক লীগের সহ-সভাপতি জহির আহমেদ পিন্টু। তিনি বলেন, ‘আমরা কয়েকজন এখানে চাকরি করি। লেকভিউ প্রকল্পের মালিক বাদল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী কাজী বাদল। তবে লেকভিউ প্রকল্প এখনো অনুমোদন হয়নি বলে স্বীকার করেন বাদল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী কাজী বাদল। তিনি বলেন, প্রকল্প অনুমোদনের কাজ চলছে। ক্রয়কৃত জমির মাটিই খনন করছেন তারা। জোর করে কারও জমি নেওয়া হয়নি। প্রকল্পের কাজ পরিচালনা করতে কাউকে কোনো ভয়ভীতি দেখানো হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি।
এ বিষয়ে বাসাইল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘মাটি উত্তোলনে ব্যবহৃত জমিগুলো দুই বা এক ফসলি। তবে জমি বিক্রি বা শ্রেণি পরিবর্তনের বিষয়গুলো আমাদের না। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে উপজেলা প্রশাসন। বাসাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পাপিয়া আক্তার বলেন, লেকভিউ প্রকল্পের নামে জেলা প্রশাসন বরাবর তারা একটি আবেদন করেছেন বলে আমি জানি। তবে অনুমোদন ছাড়া তারা কীভাবে মাটি উত্তোলন করছেন তা জেলা প্রশাসককে জানানো হবে।
বাসাইল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী অলিদ ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপি একাট্টা হয়ে মাটি-বালু উত্তোলন ও বিক্রি কাজ করছেন। দেশের কোথাও আওয়ামী লীগ-বিএনপি একাট্টা হতে না পারলেও এখানে মাটি ব্যবসায় একাট্টা হয়েছেন উপজেলার আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতারা। তিনি বলেন, ‘লেকভিউ প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন করেন টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখীপুর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম(ভিপি জোয়াহের)। ভূমি ব্যবস্থাপনা আইন ও প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকতেও কীভাবে এমপি সাহেব তিন ফসলি জমির মাটি কাটার কাজ উদ্বোধন করলেন?’
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার বলেন, ‘এর আগে উপজেলা প্রশাসন থেকে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বালু উত্তোলন বন্ধ রাখার কথা দিয়েছিলেন। তবে তারা আবার বালু উত্তোলন ও বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। খুব শিগগির এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখীপুর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলামের মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে মেসেজ পাঠালেও তিনি উত্তর দেননি।