পদ্মা-মেঘনায় চলছে ‘চোর-পুলিশ খেলা’

অভিযানের গত ১২ দিনে কোস্টগার্ড, নৌ-পুলিশসহ টাস্কফোর্সের অভিযানে শতাধিক জেলেকে আটক করা হয়েছে। মা ইলিশ রক্ষায় জলে-স্থলে টাস্কফোর্সের তৎপরতা থাকলেও তা যথেষ্ট মনে করছেন না স্থানীয়রা। জেলেদের দাবি, মৌসুমি জেলেরা চুরি করে মাছ ধরছেন। আবার অনেকে অভাবে পড়ে নিষেধাজ্ঞার সময়ে নদীতে মাছ শিকারে বাধ্য হচ্ছেন।

পদ্মা-মেঘনায় চলছে ‘চোর-পুলিশ খেলা’
প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সংরক্ষণে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই পদ্মা-মেঘনার বিভিন্ন স্থানে ইলিশ শিকার করছেন জেলেরা

প্রথম নিউজ, চাঁদপুর: প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সংরক্ষণে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই পদ্মা-মেঘনার বিভিন্ন স্থানে ইলিশ শিকার করছেন জেলেরা। মা ইলিশ নিয়ে এখন নদীতে চলছে ‘চোর-পুলিশ খেলা’। ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় নদীতে নামছেন জেলেরা। এমনকি নদীতে অভিযানকালে টাস্কফোর্সের সদস্যদের ওপর চড়াও হচ্ছেন বেপরোয়া জেলেরা।

অভিযানের গত ১২ দিনে কোস্টগার্ড, নৌ-পুলিশসহ টাস্কফোর্সের অভিযানে শতাধিক জেলেকে আটক করা হয়েছে। মা ইলিশ রক্ষায় জলে-স্থলে টাস্কফোর্সের তৎপরতা থাকলেও তা যথেষ্ট মনে করছেন না স্থানীয়রা। জেলেদের দাবি, মৌসুমি জেলেরা চুরি করে মাছ ধরছেন। আবার অনেকে অভাবে পড়ে নিষেধাজ্ঞার সময়ে নদীতে মাছ শিকারে বাধ্য হচ্ছেন।

জেলা প্রশাসন, টাস্কফোর্স ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ব্যাপকহারে মা ইলিশ নিধন করা হচ্ছে সদর উপজেলার রাজরাজেশ্বর, হরিণা, কাচিকাটা, লক্ষ্মীপুর, বিষ্ণুপুর, হাইমচরের চরাঞ্চলের নীলকমল, হাইমচর ইউনিয়ন, গাজীপুর এবং মতলব উত্তরের কয়েকটি এলাকায়। এসব মাছ বিক্রির জন্য নদীপাড়ে অস্থায়ী কিছু আড়ত গড়ে উঠেছে। প্রকাশ্যে আড়তগুলোতে মাছ বিক্রি করছেন জেলেরা। জেলেদের কাছ থেকে মাছ কিনে এক কেজি সাইজের এক হালি ইলিশ তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা।

সদরের পুরানবাজার এলাকার জেলে আকিদুর রহমান ও জসিম উদ্দিনসহ কয়েকজন জেলে বলেন, ‘আমাদের কিস্তি আছে। সংসারের খরচ চালাতে হয়। সরকার শুধু ২৫ কেজি করে চাল দেয়। শুধু চাল দিয়ে তো সংসার চলে না। আমরা কি শুধু ভাত খাই? তেল-তরকারি কেনা লাগে না? বাধ্য হয়ে নিষিদ্ধ সময়ে মাছ শিকার করতে যাই। অনেক জেলের সঙ্গে নৌ-পুলিশের যোগসাজশে রয়েছে। তাদের ম্যানেজ করেই নদীতে জাল ফেলা হয়। হাইমচরের জেলে রফিক প্রধানীয় বলেন, ‘সরকার মা ইলিশ রক্ষায় অভিযান দিয়েছে, আমরা তা মেনে চলছি। অভিযানের শুরু থেকেই আমরা জাল-নৌকা উঠিয়ে রেখেছি। তবে আমরা এখনও চাল পাইনি।’

আটককৃত কয়েকজন জেলে বলেন, ‘শুধু চাল দিয়ে তো সংসার চলে না। তাই পেটের দায়ে আমরা নদীতে নেমেছি। ধরা পড়েছি, এখন জেলে পাঠালেও কিছু করার নেই। আমাদের যদি টাকা-পয়সা থাকতো তাহলে নদীতে নামতাম না। তবে এই ২২ দিনে নদীতে মাছ বেশি পাওয়া যায়। কারণ জাল কম পড়ে। অন্য সময় তেমন পাওয়া যায় না।’

মা ইলিশ সংরক্ষণে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পদ্মা-মেঘনার বিভিন্ন স্থানে মাছ শিকার করছেন জেলেরা। পেছন থেকে তাদেরকে সহযোগিতা দিচ্ছেন ইউনিয়ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতা ও দাদনদাররা। তাদের প্রত্যক্ষ মদতে মাছ ধরা থেকে শুরু করে বিক্রি কাজটি হচ্ছে। ইতোমধ্যে ওসব প্রভাবশালীদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু কবে নাগাদ ওই তালিকা তৈরি হবে সেটি খোলাসা করেনি নৌ-পুলিশ।

যা বলছে নৌ-পুলিশ: চাঁদপুরে মা ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রমে এসে নৌ-পুলিশের অতিরিক্ত আইজি শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বড় বড় কিছু ব্যবসায়ী ও সমাজপতি জেলেদের দাদন দেন। যে সময়ে জেলেরা অভাবে থাকেন তখন উচ্চসুদে দাদন দেন তারা। দাদন নেওয়ার পর নদীতে যাওয়া জেলেদের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। অর্থাৎ জেলেদেরকে প্রভাবশালী দাদনদাররা আশ্বস্ত করেন, কোনও সমস্যা নেই, যাও, বাকিটা আমি দেখবো। এমন অবস্থায় দাদনদারের ভয়ে বা প্রশ্রয়ে জেলেরা নদীতে যাচ্ছেন। এই লোকগুলো মূলত দায়ী। তিনি বলেন, ‘দাদনদারদের অনুরোধ করছি, মা ইলিশ শিকারে আপনারা দাদন ব্যবসা বন্ধ করুন। ইলিশ মাছ শিকারিদের দাদন যারা দেন তাদের তালিকা করা হচ্ছে। জেলেদের পেছনের লোকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যাবে।’

ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে নৌ-পুলিশের অতিরিক্ত আইজি বলেন, ‘আপনাদেরকে সরকারি সিদ্ধান্তের পক্ষে থাকতে হবে। ২২ দিন মাছ ধরা বন্ধ রাখা খুব সহজ। প্রভাবশালী লোকজন, চেয়ারম্যান-মেম্বার, আড়তদার ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ চাইলে একজন জেলেও নদীতে নামবে না। নদীর খালের মুখগুলো বন্ধ রাখতে হবে। এখানে “চোর-পুলিশ” খেলা হয়। যখন পুলিশ আসে তখন খালে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। আর পুলিশ চলে গেলে নদীতে নেমে পড়ে। এটি যৌক্তিক নয়। এভাবে আপনারা নিজের ক্ষতি করছেন।’

চাঁদপুর নৌ-থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান সফল করতে আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। নিষিদ্ধ সময়ে কিছু জেলে নানা কৌশলে মাছ শিকার করছেন। কোথাও কোথাও অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে মা ইলিশ শিকারের কাজে। তাদেরকে আটক করা হলেও মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর প্রাপ্তবয়স্কদের আটকের পর মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।’ 

স্থানীয় সংসদ সদস্য ও শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, ‘প্রজনন মৌসুমে তিন সপ্তাহ মাছ না ধরলে ইলিশের উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। এরপর যখন জেলেরা নদীতে নামবে তখন চারপাশে মাছের একটা উৎসব হবে। তিনি বলেন, ‘জেলেদের পেছনে দাদনদার, আড়তদার, রাজনৈতিক, সামাজিকসহ নানা ধরনের প্রভাবশালীও জড়িত থাকেন। যারা জেলেদেরকে নদীতে নামান, দাদন দেন, যারা এখান থেকে মাছ ধরে সারা দেশে পাচার করে তাদেরকে চিহ্নিত করে ধরতে হবে এবং শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আমি প্রশাসনকে বলেছি, ব্যক্তি যেই হোক না কেন; দেশের সম্পদ বিনষ্ট করার সঙ্গে যে কেউ জড়িত থাকুক তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে।’

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী বলেন, ‘মা ইলিশ সংরক্ষণে গত ১২ দিনের (৭ থেকে ১৯ অক্টোবর) অভিযানে শতাধিক জেলেকে আটক করা হয়েছে। সেইসঙ্গে বিপুল পরিমাণ জাল জব্দ করে তা পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। আর জব্দকৃত মা ইলিশ স্থানীয় এতিমখানা ও দুস্থদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। কিছু মাছ কোল্ডস্টোরেজে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তালিকাভুক্ত জেলেদের চাল সহায়তা দেওয়া হয়েছে।’

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom