পুকুর-বর্ষা গিলে খাচ্ছে ২০ শতাংশ ইটের সড়ক

প্রকল্পের আওতায় সারাদেশের তিন হাজার ১৪৫ কিলোমিটার মাটির সড়কে ইট বসেছে। এ খাতে মোট ব্যয় ১ হাজার ২০৯ কোটি টাকা। অথচ ছয় বছরের মধ্যেই এসব সড়কের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বিলীন হয়েছে পুকুর ও ডোবায়। আরও ৫ শতাংশ এইচবিবি রাস্তা তলিয়ে গেছে বর্ষাকালে।

পুকুর-বর্ষা গিলে খাচ্ছে ২০ শতাংশ ইটের সড়ক

প্রথম নিউজ, ঢাকা : গ্রামীণ মাটির রাস্তা রক্ষা ও টেকসই করতে অবলম্বন করা হয় হেরিংবোন বন্ড (এইচবিবি) পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে মাটির রাস্তায় বালু ফেলে বিছানো হয় ইট। প্রকল্পের আওতায় সারাদেশের তিন হাজার ১৪৫ কিলোমিটার মাটির সড়কে ইট বসেছে। এ খাতে মোট ব্যয় ১ হাজার ২০৯ কোটি টাকা। অথচ ছয় বছরের মধ্যেই এসব সড়কের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বিলীন হয়েছে পুকুর ও ডোবায়। আরও ৫ শতাংশ এইচবিবি রাস্তা তলিয়ে গেছে বর্ষাকালে।

সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রকল্প সরেজমিনে পরিদর্শন করেছে সংস্থাটি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।

সরেজমিনে পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পুকুর ও খালপাড়ের রাস্তাগুলো বিভিন্ন স্থানে ভেঙে গেছে। বিশেষ করে ভারী যানবাহন চলাচল করায় রাস্তাগুলো ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢল, বন্যার পানির কারণে রাস্তা তলিয়ে যায় এবং ভেঙে যায়। মোট ১৫ থেকে ২০ শতাংশ রাস্তার পাশে পুকুর, খাল বা ডোবা থাকার কারণে বিভিন্ন স্থানে ভেঙে গেছে এবং ভেঙে যাচ্ছে। প্রায় ৫ শতাংশ এইচবিবি রাস্তা তলিয়ে গেছে বর্ষাকালে। রাস্তাগুলো আরও প্রশস্ত করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

আইএমইডি জানায়, প্রয়োজনীয় স্থানে গাইড ওয়াল নির্মাণ ও রাস্তা ভেঙে গেলে সংস্কারের ব্যবস্থা করা জরুরি। নিয়মিত সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে সড়ক এইচবিবি করা প্রয়োজন। এটি করা না হলে অর্থ ও সময় দুটোই অপচয় হবে। কোনো এলাকার মাটির রাস্তা যদি নিচু থাকে তবে সেসব এলাকায় বর্ষাকালের পরিস্থিতি বিবেচনা করে রাস্তা মাটি দিয়ে উঁচু করার জন্য আর্থিক বরাদ্দ রাখতে হবে। নতুন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে গাইড ওয়াল এবং দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকা বিবেচনা করে বাজেট প্রাক্কলন করা প্রয়োজন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রকল্পটির কোনো এক্সিট প্ল্যান তৈরি করা হয়নি। ফলে প্রকল্পটি টেকসইকরণের লক্ষ্যে সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণ ও লাইফ টাইম কত হবে সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। সুতরাং ভবিষ্যতে অনুরূপ প্রকল্পের ডিপিপি তৈরি করার সময় এক্সিট প্ল্যান, রক্ষণাবেক্ষণ ও লাইফ কত হবে সে বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার।

প্রকল্প এলাকার জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রকল্পটির ভূমিকা অপরিসীম। দেশের বিভিন্ন স্থানে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য সমজাতীয় প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে বলে জানায় আইএমইডি।

প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান  বলেন, নিয়ম ও বিধি মেনে প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো ত্রুটি থাকলে সংশ্লিষ্টদের নিয়ম অনুযায়ী অবহিত করা হয়। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নে ত্রুটি দূর হয়, পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়ে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য প্রকল্পের সঠিক সুফল জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া। সবাইকে মনে রাখতে হবে, টাকা কিন্তু জনগণের। জনগণের টাকায় জনগণ সঠিক সেবা পাচ্ছে কি না সেটা দেখাও আমাদের কাজ। আমাদের যে তথ্য পৌঁছে দেওয়া দরকার তা আমরা দেই। তবে এটা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-বিভাগের।

আইএমইডির ওই প্রতিবেদন প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন, অডিট, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা-৩) রবীন্দ্রনাথ বর্ম্মণ বলেন, পুকুর ও জলাশয়ের কারণে ইটের সড়ক নষ্ট হচ্ছে। আইএমইডির প্রতিবেদনের সঙ্গে আমরা একমত। সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালককে বলেছি এটা টেকসই করতে। প্রয়োজনে পুকুর বা জলাশয়ে সাইড ওয়াল দিতে হবে। সাইড ওয়াল দেওয়ার পরই করতে হবে হেরিংবোন বন্ড। যেখানে ইটের সড়ক ডুবে যাচ্ছে সেখানে সড়ক মাটি দিয়ে উঁচু করা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশ গ্রামে বসবাস করে। গ্রামাঞ্চলে দরিদ্রতার হার বেশি। ভূমিহীন, প্রান্তিক কৃষক, কর্মসংস্থানের অভাব ইত্যাদি কারণে গ্রামীণ জনগণের আয়-ক্ষমতা কম। প্রতিটি উপজেলায় স্থানীয় হাট-বাজার, হেলথ সেন্টার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ইউনিয়ন পরিষদ যেসব গ্রামীণ মাটির রাস্তা দ্বারা সংযুক্ত রয়েছে সেগুলো এইচবিবিকরণের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই করা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা, কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ সহজ ও পরিবহন ব্যয় কমিয়ে আনা, দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস করা এবং চিকিৎসাসেবা গ্রহণ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে সারাদেশে ৪৯২টি উপজেলায় ওই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।

আইএমইডি’র প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রভাব মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে কাঠামোগত প্রশ্নের মাধ্যমে ১ হাজার ২শ জন উপকারভোগী ও ৬শ জন উপকারভোগী নন এমন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও অংশীজনের সঙ্গে ৫০টি ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে প্রকল্পের গুণগত তথ্য। এছাড়া সেকেন্ডারি উৎস থেকে প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি, প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দের ব্যবহার এবং প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

প্রকল্পটি ১৪ মার্চ ২০১৭ সালে একনেক সভায় অনুমোদন করা হয়। ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) অনুসারে প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ছিল জুলাই ২০১৬ থেকে জুন ২০২১ পর্যন্ত।

আইএমইডি জানায়, প্রভাব মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অধিকাংশ উপকারভোগী (৮৫ শতাংশ) বলেছেন, মাটির রাস্তা এইচবিবিকরণের ফলে গ্রামীণ এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। ফলে সহজ হয়েছে যাতায়াত। প্রায় তিন-চতুর্থাংশ উপকারভোগী বলেন, গ্রামীণ রাস্তা এইচবিবিকরণের পর স্থানীয় কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ সহজ হয়েছে ও কমেছে পরিবহন ব্যয়। প্রকল্পের ফলে স্থানীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বল্পমেয়াদি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষ করে নারীদের।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কর্মবণ্টনে রাস্তা নির্মাণের বিষয়টি উল্লেখ না থাকলেও ১৯৭৫ সাল থেকে গ্রামীণ এলাকায় মাটির রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব রাস্তা সংরক্ষণ করছে এ মন্ত্রণালয়। বর্ষা মৌসুমে মাটির রাস্তা কর্দমাক্ত হয় এবং নষ্ট হয়ে যায়। তাই রাস্তার আয়ুষ্কাল বাড়ানো এবং রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় কমানোর জন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়।