নতুন করে সক্রিয় চাঁদাবাজ-দখলবাজরা, টার্গেট সরকারি জমি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান

প্রথম নিউজ, অনলাইন: টঙ্গীতে সরকারি জমিতে স্থাপনা নির্মাণ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি এবং বিভিন্ন গার্মেন্টের ঝুট ব্যবসায় প্রভাবশালীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকা চাঁদাবাজ-দখলবাজরা এখন বেশ সক্রিয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আগের দখলবাজ-চাঁদাবাজদের আত্মগোপনের সুযোগে এখন নতুন করে চলছে দুর্বৃত্তায়ন। চাঁদাবাজি-দখলবাজিতে অভিযোগের তির এখন বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের স্থানীয় নেতাকর্মীর দিকে। তাদের সঙ্গে রয়েছে সুবিধাভোগীরা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, খাসজমি ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সম্পদ, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ঝুট ব্যবসা, ফুটপাত, ড্রেন থেকে শুরু করে সর্বত্র চলছে দখলের প্রতিযোগিতা। দখল নিয়ে সংঘর্ষ-গুলির ঘটনাও ঘটেছে। এক তথ্যে জানা যায়, শুধু অবৈধভাবে গড়ে তোলা দোকানপাট থেকে চাঁদা উঠছে মাসে সাড়ে চার কোটি টাকা। আর ঝুট ব্যবসা থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে অন্তত শতকোটি টাকা। আগে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীদের দখলে ছিল এসব অবৈধ বাণিজ্য। এখন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় প্রভাবশালী ও তাদের সহযোগীরা এসবের নিয়ন্ত্রণ করছেন। সড়ক, মহাসড়ক, ফুটপাতের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে কয়েক হাজার দোকানপাট। এসব দোকান থেকে দৈনিক ৩শ থেকে ৫শ টাকা করে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। আবার কোনো কোনোটির পজিশন বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকায়।
ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধ : টঙ্গীতে রয়েছে তিন শতাধিক শিল্পকারখানা। এসব কারখানায় প্রতিটি থেকে ৫ থেকে ২০ লাখ টাকার ঝুটপণ্য বের হয়। বিভিন্ন ফ্যাক্টরির কর্মকর্তারা জানান, সরাসরি বিক্রি করতে পারলে যে ঝুট থেকে পাওয়া যেত ৫০ লাখ টাকা। সেই ঝুট প্রভাবশালীদের কাছে বিক্রি করতে হয় ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকায়। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি টাকা চলে যায় প্রভাবশালীদের পকেটে। আগে আওয়ামী লীগের স্থানীয় প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল ঝুটের ব্যবসা। এখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের প্রভাবশালীদের। ঝুট ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে দুপক্ষে।
১৫ জানুয়ারি পাগাড় সোসাইটি মাঠ এলাকায় ‘উইন্ডি অ্যাপারেলস লিমিটেড’-এর ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিএনপি নেতা মুক্তিযোদ্ধা হাসান উদ্দিন সরকারের পিএস কিবরিয়া খান জনির পক্ষের লোকজনের সঙ্গে স্থানীয় যুবদলের এক নেতার অনুসারীদের সংঘর্ষ হয়। এছাড়া গত ১৮ ফেব্রুয়ারি টঙ্গী বিসিকের আনোয়ার সিল্ক মোড়ে ঝুট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বিএনপি নেতা মুক্তিযোদ্ধা হাসান উদ্দিন সরকারের নাম ভাঙিয়ে তার পিএস কিবরিয়া খান জনি টঙ্গী এলাকায় ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে আধিপত্য বিস্তার করছেন।
অভিযোগের বিষয়ে কিবরিয়া খান জনি বলেন, আমি এসব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নই। আমার সঙ্গে উইন্ডি অ্যাপারেলস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ঝুট ব্যবসার চুক্তি হয়েছিল। এটি নিয়ে যুবদলসহ অন্যদের সঙ্গে বিরোধ হয়। এ ঘটনায় আমার নামে একটি মামলাও হয়েছে। এরপর থেকে ঝুটের সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তিনি বলেন, টঙ্গী পূর্ব এবং টঙ্গী পশ্চিম থানা বিএনপির বিভিন্ন কমিটির নেতারাই টঙ্গীর ঝুটের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন।
টঙ্গী পশ্চিম থানা বিএনপির সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘আমি সরাসরি ঝুটের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নই। বিভিন্ন ওয়ার্ডের নেতাকর্মীদের ভাগবাঁটোয়ারা করে দিয়েছি। তারা এসব করে খাচ্ছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামী লীগের সময়ে যারা ঝুটের ব্যবসা করত, তাদের কেউ কেউ এখনো সক্রিয় রয়েছে। বিএনপিতে পদপদবি নেই, এমন লোকজনও এখন সুবিধা নিচ্ছে।
টঙ্গী পূর্ব থানা বিএনপির সভাপতি সরকার জাবেদ আহমেদ সুমন যুগান্তরকে বলেন, কারখানাগুলোর ঝুটের ২০ শতাংশ ব্যবসা আমাদের লোকজন করছে। আর ৮০ শতাংশ ব্যবসা এখনো ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসরদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এছাড়া চাঁদাবাজির যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, এগুলো সঠিক নয়।
দখলবাজি : টঙ্গী পূর্ব থানার পেছনে তালতলা রোড, মেঘনা বটতলা রোড, সোনালী ট্যোবাকো রোড, ন্যাশনাল টিউবস রোড, টঙ্গীবাজার মিতালী পাম্পের দক্ষিণে মহাসড়কের পাশে কাপড়ের বাজার, টঙ্গীবাজার সংলগ্ন তুরাগ নদের তীর, হাজী মার্কেট, মিলগেট, দত্তপাড়া, আউচপাড়া, এরশাদনগরসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়ক ও মহাসড়কের জমি দখল করে নিয়েছে সুবিধাভোগীরা। এসব এলাকাসহ আশপাশের অন্যান্য এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে প্রায় ৪ হাজার ছোট-বড় দোকান। এসব দোকান থেকে দিনে ৩ থেকে ৫শ টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।
টঙ্গীর মেঘনা বটতলা এলাকায় সড়কের পাশে অবৈধভাবে জমি দখল করে ঝুটের গোডাউন তৈরি করেছিল ছাত্রলীগ নেতা হুমায়ূন কবির বাপ্পী। পট পরিবর্তনের পর এই ঘর দখল করেছেন ছিদ্দিকুর রহমান নামে এক ঝুট ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, দখলে নিয়েছি ঠিক আছে; কিন্তু চাঁদা দিতে দিতে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ফুটপাতের চাঁদাবাজি, ময়লা বাণিজ্যেও হাতবদল হয়েছে। ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য এলাকাভিত্তিক দলীয় প্রভাব খাটানোর চেষ্টা চলমান রয়েছে। ফুটপাতের এক ব্যবসায়ী আক্ষেপ করে বলেন, অবস্থাটা এমন যে, ‘রাস্তা দিয়ে লাশ কাঁধে করে নিয়ে গেলেও চাঁদা দিয়ে যেতে হবে।’
অভিযোগ রয়েছে, সাবেক দুই কাউন্সিলর, ৫৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতাসহ ৬ জনের সিন্ডিকেট ওই ওয়ার্ড এলাকার ঝুট ব্যবসা, অবৈধ দোকানপাট দখল, সরকারি জমিতে স্থাপনা তৈরি করে পজিশন বিক্রি করছেন। তারা সম্প্রতি টঙ্গীর মিলগেট এলাকায় অলিম্পিয়া মসজিদের উত্তর পাশে সরকারি জমিতে ১১টি টিনশেড দোকানঘর নির্মাণ করে বিক্রি করে দেন। স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, একেকটি দোকান ১ লাখ ৪০ হাজার টাকায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে সাবেক কাউন্সিলর সেলিম হোসেন ‘আমি এসব বিষয়ে ফোনে কথা বলতে চাই না’ বলে সরকারি জমি দখল করে পজিশন হস্তান্তরের বিষয়টি এড়িয়ে যান।
৪৬ নম্বর ওয়ার্ড মেঘনা বটতলা রোডে এবং পাশের আরও একটি সড়কে প্রায় ৬০টি স্থাপনা নির্মাণ করে ঝুটের গুদাম হিসাবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি দোকান থেকে মাসে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে তিন থেকে চার হাজার টাকা। এসবের নেপথ্যেও রয়েছেন স্থানীয় পেশিশক্তি। টঙ্গী-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের দুইপাশের ফুটপাত দখল করে কয়েক শ দোকান বসিয়ে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এছাড়া সুলতান মার্কেটের সামনে থেকে আব্দুল্লাহপুর ব্রিজ পর্যন্ত সরকারি জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে ৪ শতাধিক দোকান। প্রতি দোকান থেকে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এসব দোকান থেকে চাঁদা আদায় করেন ক্যাসেট শামীম ও তার লোকজন।
অভিযোগের বিষয়ে ক্যাসেট শামীম বলেন, আমরা কোনো চাঁদাবাজি করি না, লিগ্যালভাবেই ভাড়া তুলি।
টঙ্গী স্টেশনরোড, মিলগেট এলাকার সুন্দর আলী সড়কে পার্কিং করা ৫ শতাধিক কাভার্ডভ্যান থেকে গাজীপুর জেলা ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হাজি আব্দুর রশিদের লোকজন চাঁদাবাজি করছে। ভুক্তভোগীরা জানান, দিনে পার্কিং করলে ১ থেকে ২০০ টাকা এবং রাতে ৭ থেকে ৮শ টাকা করে প্রতি গাড়ি থেকে আদায় করা হচ্ছে।
অভিযোগের বিষয়ে আব্দুর রশিদ বলেন, এসব গাড়ি পাহারা দিতে ১২ জন দারোয়ান কাজ করে। টাকা তুলে দারোয়ানদের বেতন দিই।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউকের উপপরিচালক (এস্টেট ও ভূমি) মো. সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, টঙ্গী শিল্পাঞ্চল এলাকায় রাজউকের কিছু প্লট রয়েছে। এগুলোয় প্রায়ই অবৈধ দখলদাররা স্থাপনা তোলার চেষ্টা করে। আমরা এগুলো উচ্ছেদ করে দিই। আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকতা মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, সিটি করপোরেশনের জায়গায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান করি। আমাদের অভিযান চলমান আছে।