Ad0111

নাচ শেখানোর প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের কৌশলে বিভিন্ন দেশে পাচার করা হতো

নাচ শেখানোর প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের কৌশলে পার্শ্ববর্তী দেশ হয়ে বিভিন্ন দেশে পাচার করা হতো।

নাচ শেখানোর প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের কৌশলে  বিভিন্ন দেশে পাচার করা হতো
ছবি: সংগৃহীত

প্রথম নিউজ, ডেস্ক: নাচ শেখানোর প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের কৌশলে পার্শ্ববর্তী দেশ হয়ে বিভিন্ন দেশে পাচার করা হতো। এরকম ২৩ নারীকে সম্প্রতি উদ্ধার করা হয়েছে। মানবপাচারের অভিযোগে চক্রের মূল হোতা মো. কামরুল ইসলাম ওরফে জলিল ওরফে ডিজে কামরুল ওরফে ড্যান্স কামরুলসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। শনিবার সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ‌্য জানিয়েছেন র‌্যাবের আইন ও গণমাধ‌্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি জানান, শুক্রবার (২৯ অক্টোবর) রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা ও তেজগাঁও থেকে ২২ নারী এবং চুয়াডাঙ্গার জীবনগর থেকে আরও এক নারীকে উদ্ধার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দুটি মানবপাচার চক্রের সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর, খিলক্ষেত ও চুয়াডাঙ্গা থেকে পার্শ্ববর্তী দেশে মানবপাচার চক্রের মূল হোতা ডিজে কামরুল, মো. রিপন মোল্লা, মো. আসাদুজ্জামান সেলিম, মো. নাইমুর রহমান ওরফে শামীম এবং ঝিনাইদহ, বনানী, পল্লবী, তেজগাঁও ও উত্তরা থেকে মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচার চক্রের মূল হোতা মো. নুর-নবী ভুইয়া রানা, মো. আবুল বাশার, মো. আল ইমরান, মনিরুজ্জামান, মো. শহিদ সিকদার, প্রমোদ চন্দ্র দাস, মো. টোকনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৫৩টি পাসপোর্ট, ২০টি মোবাইল ফোন, ৮ বোতল বিদেশি মদ, ২৩ ক্যান বিয়ার, ২টি মোটরসাইকেল, ১টি ল্যাপটপ, ১ সেট কম্পিউটারসহ মানবপাচার সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র জব্দ করা হয়।

খন্দকার আল মঈন আরও জানান, পার্শ্ববর্তী দেশে মানবপাচার চক্রের সদস্য ১৫-২০ জন। ২০১৯ সাল থেকে চক্রটি সক্রিয়ভাবে মানবপাচার করছে। চক্রটি দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কম বয়সী মেয়েদের ফাঁদে ফেলে এবং প্রলোভন দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে। প্রথমে চক্রটি নাচ শেখানোর নামে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সুন্দরী মেয়েদের ঢাকায় নিয়ে আসতো। তাদের বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত করত। পরে তাদের পার্শ্ববর্তী দেশে বিভিন্ন চাকরির কথা বলে প্রলুব্ধ করে পাচার করত। এভাবে চক্রটি গত দুই-তিন বছরে শতাধিক মেয়েকে পাচার করে। পার্শ্ববর্তী দেশে মার্কেট, সুপারশপ, বিউটি পার্লারসহ বিভিন্ন স্থানে লোভনীয় চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হতো।

তিনি বলেন, ‘মূলত অনৈতিক কাজ করানোর উদ্দেশ্যে নারীদের পাচার করা হতো। চক্রটি রাজধানীসহ দেশের কয়েকটি এলাকায় সক্রিয় আছে। তারা মেয়েদের সীমান্তের অরক্ষিত এলাকা দিয়ে পাচার করে। এসব চক্রের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশের সিন্ডিকেটের যোগসাজশ আছে। পাশের দেশের চক্রের সদস্যরা পাচারের জন্য আনা মেয়েদের জন‌্য ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে। এর পর বিপুল অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন শহরে/প্রদেশে অনৈতিক কাজ করানোর উদ্দেশ্যে বিক্রি করে।’ 

খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘কামরুল ২০০১ সালে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় পাড়ি জমায়। প্রথমে সে বাড্ডা এলাকায় রিকশা চালাতো। কিছুদিন পর সে একটি কোম্পানির ডেলিভারি ভ্যানের চালক হিসেবে কাজ নেয়। এরপর সে ড্যান্স গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে হাতিরঝিল এলাকায় ডিজে কামরুল ড্যান্স কিংডম নামে একটি ড্যান্স ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে। ড্যান্স ক্লাবের মাধ্যমে সে বিভিন্ন উঠতি বয়সী মেয়েদের বিনোদন জগতে প্রবেশে প্রলুব্ধ করতো। একপর্যায়ে তাদের উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাশের দেশে পাচার করত। সে কয়েকবার পাশের দেশে ভ্রমণ করে। ওই দেশের নারী পাচারকারী চক্রের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। ২০১৯ সালে এপ্রিল মাসে সে তার ড্যান্স ক্লাবের এক নারীকে পাশের দেশের বিউটি পার্লারে বেশি বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করে। ওই ঘটনায় মেয়েটির বোন তার বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে মামলা দায়ের করেন। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময় বাড্ডা থানা পুলিশ ড‌্যান্স কামরুলকে আটক করে। তিন মাস কারাগারে ছিল কামরুল। জামিনে কারামুক্ত হয়ে পুনরায় মানবপাচার কার্যক্রম অব্যাহত রাখে সে।’

চক্রটি পরিকল্পনা মোতাবেক নারীদের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলায় অবস্থিত সেফ হাউজে রাখত। সেখানে তাদের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হতো। এরপর সুবিধাজনক সময়ে চক্রের সদস্যরা  নারীদের অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে পাচার করে দিতো।

গ্রেপ্তারকৃত রিপন, সেলিম এবং শামীম নারী পাচারে কামরুলকে সহায়তা করতো বলে স্বীকার করেছে। রিপন মোল্লা ডেলিভারি ম্যান হিসেবে কাজ করে। আসাদুজ্জামান সেলিম বর্তমানে উত্তরা এলাকায় ব্যবসা করে এবং পাশাপাশি মূল হোতা কামরুলকে পাচারে সহযোগিতা করতো। নাইমুর রহমান ওরফে শামীম সীমান্ত এলাকায় সেফ হাউজ পরিচালনা, অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার ও পাশের দেশের দালালের কাছে নারীদের হস্তান্তর করতো।

এ পর্যন্ত চক্রটি ৩০-৩৫ জন নারীকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে। পাচারকারীরা ঢাকায় কয়েকটি সেফ হাউজ পরিচালনা করে। কয়েকদিন সেফ হাউজে নারীদের আটকে রেখে মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যে নারীদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করা হতো।

মানবপাচার চক্রের সদস‌্যরা প্রথমে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কম বয়সী এবং অস্বচ্ছল তরুণী ও মধ্যবয়স্ক নারীদের টার্গেট করে তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। পরে বিদেশে বিভিন্ন লোভনীয় চাকরির প্রলোভন দেখায়। এতে তারা রাজি হলে প্রথমে তাদের ঢাকায় সাজানো অফিসে এনে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে এবং বিদেশে নেওয়ার জন্য স্বল্পকালীন ভুয়া প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। এ সময় কোন নারী বিদেশে যেতে অনীহা প্রকাশ করে পাসপোর্ট ফেরত চাইলে তাদের কাছ থেকে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা দাবি করা হয়।

মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচারকারী চক্রের মূল হোতা মো. নুর-নবী ভুইয়া রানা। রানা লক্ষ্মীপুরের কলেজ থেকে ১৯৯৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে। ১৯৯৬ সালে সে ঢাকায় এসে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি নেয়। ১৯৯৮ সাল থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমানে কাজ করে। ওমানে থাকা অবস্থায় একটি মানবপাচার চক্রের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয় এবং তখন থেকেই মানবপাচার কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে সে। ২০২০ সালে ওমান থেকে দেশে ফিরে মানবপাচারে পুরোপুরি সক্রিয় হয়।

ডিজে কামরুলের নামে রাজধানীর বাড্ডা থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে একটি মামলা আছে। অপর চক্রের সদস্য মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে সবুজবাগ থানায়, প্রমোদের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় এবং টোকনের নামে যশোরের অভয়নগর থানায় মামলা আছে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার খন্দকার আল মইন বলেন, ‘চলতি বছরের মে মাসে পার্শ্ববর্তী দেশে বাংলাদেশের এক তরুণীর পৈশাচিক নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে র‌্যাব পার্শ্ববর্তী দেশে মানবপাচার চক্রের অন্যতম হোতা বস রাফিসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। এছাড়া, একজন মা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েকে পাচারকারীদের কাছ থেকে উদ্ধারের ঘটনা প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হলে পাচারকারী চক্রের কাল্লু-সোহাগ ওরফে কাল্লু-নাগিন সোহাগ ওরফে মামা-ভাগিনা ওরফে কালা-নাগিন সিন্ডিকেটের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

ঘটনাগুলো দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের ফলে পাচারের শিকার কয়েক নারীর পরিবার প্রতিকারের আশায় র‌্যাবের কাছে অভিযোগ করে। এর ভিত্তিতে র‌্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে। এর পরেই ড্যান্স কামরুলের তথ‌্য বেরিয়ে আসে।

সূত্র: রাইজিং বিডি

 

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

This site uses cookies. By continuing to browse the site you are agreeing to our use of cookies & privacy Policy from www.prothom.news