ধর্ষণের সালিশের জরিমানার টাকা মাতব্বরদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা, ধর্ষিতার আত্মহত্যা
বিয়েতে রাজি না হওয়ায় ওই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা করতে প্রস্তুতি নেন ওই নারী।

প্রথম নিউজ, ময়মনসিংহ: বিয়ের কথা বলে স্বামী পরিত্যক্তা এক নারীকে মাসের পর মাস ধর্ষণ করে আলফাজ নামে এক যুবক। বিয়েতে রাজি না হওয়ায় ওই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা করতে প্রস্তুতি নেন ওই নারী। এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক নেতা ও কয়েকজন গ্রাম্য মাতব্বর। এক ইউপি সদস্যের চেম্বারে শালিসের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয় ধর্ষিতাকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার। ক্ষতিপূরণের টাকা ঠিকই নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু সেখানে ভাগ বসায় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক নেতাসহ কয়েক মাতব্বর। ক্ষতিপূরণের টাকা ও ধর্ষণের বিচার না পাওয়ায় মনের দুঃখে ঘটনার সঙ্গে জড়িত আলফাজের বাড়িতে গিয়ে বিষপানে আত্মহত্যা করেন ওই নারী। ঘটনাটি ঘটেছে গত শুক্রবার বিকালে মুক্তাগাছা উপজেলার পোড়াবাড়ী গ্রামে। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। সরজমিন স্থানীয় ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুক্তাগাছা উপজেলার দাওগাঁও ইউনিয়নের পোড়াবাড়ী গ্রামের মাইন উদ্দিনের মেয়ে দেলোওয়ারা বেগম (৩৫) গাজীপুরের একটি গার্মেন্টে চাকরি করতেন।
সেখানে রংপুরের এক ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ে টিকেনি বেশিদিন। কয়েকমাস আগে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়। দেলোয়ারা বেগম বাবার বাড়ি মুক্তাগাছার পোড়াবাড়ীতে এসে স্থানীয় বটতলা বাজারে মুদির দোকান শুরু করে। বাজারের চা দোকানদার আলফাজের (৪০) সঙ্গে সখ্যতার পর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আলফাজ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে দেলোয়ারার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হলে বিয়ের জন্য চাপ দেয় দেলোয়ারা। আলফাজ বিয়ে করতে অস্বীকার করলে, দেলোয়ারা আলফাজের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নেয়। বিষয়টি স্থানীয় মাতব্বররা আলফাজের পক্ষ নিয়ে দেলোয়ারার পরিবারের কোনো লোকছাড়াই বটতলা বাজারের বিরাজ মেম্বারের চেম্বারে সালিশ হয়। সালিশে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করে ধর্ষককে। তার মধ্যে ১ লাখ টাকা দেলোয়ার দূর-সম্পর্কের আত্মীয় হাফেজ আহাম্মদ আলীর মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয়া হয়। বাকি ৬০ হাজার টাকা মাতব্বররা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয় বলে এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায়। এখানেই শেষ নয়, দেলোয়ারা টাকা নিয়ে বাড়ি যাওয়ার পর স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি শফিক দেলোয়ারার বাড়িতে গিয়ে তাকে ভয় দেখিয়ে ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। স্বামী ও টাকা উভয় হারিয়ে মনের দুঃখে দেলোয়ারা গত ১লা ফেব্রুয়ারি আলফাজের বাড়িতে বিষপান করে। বিষপান করা অবস্থায়ই তার ওপর শারীরিক নির্যাতন করে বটতলা বাজারের রাস্তায় ফেলে যায়।
খবর পেয়ে ইউপি চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন বাদশা চৌকিদার পাঠিয়ে দ্রুত মুক্তাগাছা হাসপাতালে প্রেরণ করলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ উন্নত চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় গত ৩রা ফেব্রুয়ারি বিকাল সাড়ে ৪টায় দেলোয়ারা মারা যায়। এ ব্যাপারে হাফেজ আহম্মদ আলীর সঙ্গে কথা হলে তিনি সালিশ ও জরিমানার বিষয়টি স্বীকার করেন। ইউপি মেম্বার বিরাজ আলী সালিশ ও জরিমানার কথা স্বীকার করেন। দেলোয়ারার মা-বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, দেলোয়ারার ওপর ব্যাপক অত্যাচার করা হয়েছে। সালিশের বিষয়ে তাদের জানানো হয়নি। আলফাজের পক্ষ হয়ে মাতব্বররা টাকার বিনিময়ে একতরফা সালিশ করেছে। শুধু তাই নয়, সালিশের টাকার উপর ভাগ বসিয়ে দেলোয়ারাকে ঠকিয়েছে মাতব্বররা। তাই সে মনের দুঃখে আত্মহত্যা করেছে। আমরা এর ন্যায় বিচার চাই।
এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে মুক্তাগাছা থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুল মজিদ বলেন, এ বিষয়ে থানায় মামলা হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ধর্ষণ সংক্রান্ত কোনো ঘটনা সালিশ অযোগ্য। একমাত্র বিচারের এখতিয়ার আদালতের। এখানে যারা সালিশ করেছে তা সম্পূর্ণ অবৈধ ও আইন পরিপন্থি। যারা সালিশ করবেন তারা আইনের আওতায় আসার বিধান রয়েছে। এ ব্যাপারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ভুক্তভোগী পরিবার।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: