ধ্বংসের মুখে রূপগঞ্জের জমিদার বাড়ি

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বাড়িটি নিয়ন্ত্রণে নিলেও এর সংরক্ষণে কোনো পদক্ষেপ নেই

ধ্বংসের মুখে রূপগঞ্জের জমিদার বাড়ি

প্রথম নিউজ, অনলাইন:  বাড়িটি কোথায় ছবি দেখলে অনেকের চেনার কথা। অথবা মনে হতে পারে কোথায় যেন দেখেছি। সারা দেশের মানুষই এর গঠন ও কারুকার্যে মুগ্ধ। তবে রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া ইউনিয়নের মুড়াপাড়া গ্রামে শীতলক্ষ্যা নদের পূর্বপাড়ে অবস্থিত রামরতন ব্যানার্জীর জমিদার বাড়িটি এখন ধ্বংসের মুখে।
১৮০০ শতাব্দীতে জমিদার রামরতন ব্যানার্জী কর্তৃক নির্মিত এ বাড়িটির বেহাল দশা। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বাড়িটির নিয়ন্ত্রণে নিলেও তার কোনো সুফল নেই। রাজধানী ঢাকার অতি সন্নিকটে রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি এটি।

বাড়িটির নির্মাণশৈলী ও কারুকাজ রুচিসম্মত যেকোনো মানুষকে আকৃষ্ট করে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আসেন সুবিশাল বাড়িটি দেখতে। ১৭৬ বছর পূর্বে প্রায় ৫২ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত জমিদার বাড়িটি এখন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই এই মূল্যবান ঐতিহ্যবাহি বাড়িটি সংরক্ষণে।
দায়িত্বরতদের অবহেলায় ধ্বংসের মুখে এই মহাকীর্তি। রাজা-জমিদারদের যুগে রাজবাড়িতে থাকত ‘হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া।’ এখন সেই রাজাও নেই, জমিদারও নেই। রাজা-জমিদারদের রাজবাড়ি এখন ধ্বংসের পথে।

বাড়ির শুরুতেই বিশাল আম্রকানন, রাজবাড়ির প্রধান ফটক, স্বচ্ছ পুকুর, সৌন্দর্যমণ্ডিত মন্দির আর সারি-সারি কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন যে কেউ।
রাজবাড়িটির পেছনে রয়েছে শান্ত পুকুর, নির্জন পরিবেশ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও শতবর্ষী জমিদার বাড়ি এটি। বিভিন্ন সময় এ জমিদার বাড়িটি কয়েকজন জমিদার কর্তৃক সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়েছিল। মুড়াপাড়া রাজবাড়িটি ৫২ বিঘা জমির ওপর গড়ে উঠেছে। গোড়পত্তন করেন বাবু রামরতন ব্যানার্জী। এরপর তার কয়েকজন বংশধর কর্তৃক প্রাসাদটি সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে জমিদার প্রতাপচন্দ্র ব্যানার্জী এই ভবনের পেছনের অংশ সম্প্রসারণ করেন ও পরিবার নিয়ে এখানেই বসবাস শুরু করেন।

তার পুত্র বিজয় চন্দ্র ব্যানার্জী ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রাসাদের সামনের অংশে একটি ভবন নির্মাণ ও ২টি পুকুর খনন করেন। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে তার দুই পুত্র জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জী ও আশুতোষ চন্দ্র ব্যানার্জী কর্তৃক প্রাসাদের দোতালার কাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর জগদীশ চন্দ্র তার পরিবার নিয়ে কলকাতা গমন করেন। এরপর থেকে বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাড়িটি দখল নেয় এবং এখানে হাসপাতাল ও কিশোরী সংশোধন কেন্দ্রের কার্যক্রম পরিচালনা করা হত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বাড়িটির দায়িত্ব গ্রহণ করে সেটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।

স্থানীয় কয়েকজন সত্তোর্ধ্ব মুরুব্বীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সময়ের ঘোড়ার পায়ের ঠক ঠক শব্দ, হাতির পিঠে চড়ে জমিদারদের ভ্রমণ, পাইক পেয়াদার পদচারণায় মুখরিত ছিল যে বাড়িটি আজ তা প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মৃতি শুধু। কালের গহ্বরে প্রাচীন ঐতিহ্যে ঢাকা পড়লেও এর নিদর্শন চিরকাল অম্লান। রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ার জমিদার বাড়িটি তেমনই একটি স্মৃতিচিহ্ন। এ বাড়িটিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে রূপগঞ্জের ইতিহাস, কৃষ্টি, সভ্যতা ও আজকের এই কোলাহলপূর্ণ জনবসতি। শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ঘেঁষে মহাকালের নীরব সাক্ষী হয়ে আজো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এ জমিদার বাড়ি। পাখি ডাকা ছায়া সু-নিবিড় পরিবেশে গড়ে ওঠা মনোমুগ্ধকর এ জমিদার বাড়িটি দেখতে যে কারো মান চাইবে।
 

রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার মুড়াপাড়া এলাকায় ৫২ বিঘা জমির ওপর এই প্রকাণ্ড জমিদার বাড়ি অবস্থিত। জমিদার বাবু রামরতন ব্যানার্জী তৎকালীন মুড়াপাড়া জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ির গোড়াপত্তন করেন। রামরতন ব্যানার্জীর ছেলে পিতাম্বর ব্যানার্জী এবং তৎপুত্র প্রতাপ চন্দ্র ব্যানার্জী শাহজাদপুরের জমিদারি ক্রয় করে জমিদারি শুরু করেন।

কথিত আছে, জমিদারি ক্রয় সূত্রে প্রতাপ ব্যানার্জীর সঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। ১৮৮৯ সালে প্রতাপ চন্দ্র ব্যানার্জীর পৈতৃক এজমালি পুরনো বাড়ি ত্যাগ করে আলোচ্য এ প্রাসাদের পেছনের অংশ নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন। প্রতাপ চন্দ্র ব্যানার্জীর পুত্র বিজয় চন্দ্র ব্যানার্জী ১৮৯৯ সালে প্রাসাদের সম্মুখ অংশের একতলা ভবন নির্মাণ ও সেখানে ২টি পুকুর খনন করার পর জটিল রোগে ভুগে মারা যান। তিনি ছিলেন এ অঞ্চলের প্রথম গ্র্যাজুয়েট। বিজয় চন্দ্র ব্যানার্জীর দুই পুত্র জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জী ও আশুতোষ চন্দ্র ব্যানার্জী ১৯০৯ সালে প্রাসাদটির দোতলার কাজ সম্পন্ন করেন। এ অঞ্চলে জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জীর নাম সমধিক প্রসিদ্ধ। কারণ তিনি দু’বার দিল্লির কাউন্সিল অব স্টেটের পূর্ববঙ্গ থেকে সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। জমিদার জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জী প্রজা সাধারণের কল্যাণসাধনের জন্য স্থাপন করেছেন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও পুকুর। জমিদারদের আয়ের উৎস বলতে ছিল- প্রজার ওপর ধার্যকৃত খাজনা আদায়, বন জঙ্গল এবং সুপারির বাগান।

১২০০ বঙ্গাব্দে এসে প্রজাদের ওপর শুরু হয় তাদের অত্যাচার-নিপীড়ন, ক্ষমতার অপব্যবহার। মেয়ে, ঘরের বধূ, তাদের ওপর লোলুপ দৃষ্টি পড়লে রেহাই পেত না। ধীরে ধীরে অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকে। আজো সেসব অত্যাচার, নির্যাতন এবং প্রভাব বিস্তারের গল্প গ্রামাঞ্চলে কল্পকাহিনীর মতো ছড়িয়ে আছে। জমিদারি প্রথার শেষ দিকে নানাভাবে বিদ্রোহের পটভূমি তারই অংশ।

কথিত আছে, জমিদার বাড়িতে দুটি গোপন সুরঙ্গ রয়েছে। একটি সুরঙ্গ থেকে প্রতি অমাবস্যাতে প্রকাণ্ড সাপ বের হয়ে সামনের পুকুরে স্নান করে। তবে এর সঠিক ভিত্তি পাওয়া যায়নি। আরেকটি সুরঙ্গের তালা আজ অবধি কেউ খুলতেই পারেনি। তবে এ প্রতিবেদক দেখার চেষ্টা করে কোনো প্রমাণ পাননি। 

১৯৪৭ সালে তৎকালীন জমিদার জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জী সপরিবারে কলকাতায় চলে যান। ফলে জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জীর প্রতাপশালী সেই রাজবাড়িটি শূন্য হয়ে যায়। ১৯৪৮ সালে এই ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি সরকারের দখলে চলে আসে। তৎকালীন সরকার এখানে একটি হাসপাতাল স্থাপন করে। কিছুকাল এটি কিশোর সংশোধনী কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। পরে ১৯৬৬ সালে এখানে হাইস্কুল ও কলেজ স্থাপিত হয়। বর্তমানে এই জমিদার বাড়িটি মুড়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বাড়িটি ঘুরে জানা গেছে, বিশাল দোতলা এ জমিদার বাড়িটিতে রয়েছে মোট ৯৫টি কক্ষ। নাচঘর, আস্তাবল, উপাসনালয়, ভাণ্ডার, কাচারি ঘরসহ সবই। বিশালাকৃতির প্রধান ফটক পেরিয়ে ঢুকতে হয় ভেতরে। অন্দর মহলে রয়েছে আরো ২টি ফটক। সর্বশেষ ফটক পেরিয়ে নারীদের স্নানের জন্য ছিল শানবাঁধা পুকুর। পুকুরের চারধার উঁচু দেয়ালে ঘেরা। এখানে প্রবেশ বাইরের লোকদের জন্য ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সচরাচর কোনো পুরুষ যেত না সেখানে। বাড়ির সামনে রয়েছে আরো একটি বিশাল পুকুর। পুকুরটির চারদিক নকশি কাটা ঢালাই লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা। আর চারদিকে চারটি শানবাঁধানো ঘাট।

মূলত এ পুকুরটি তৈরি করা হয়েছিল বাড়ির সৌন্দর্য বর্ধন এবং পুরুষ মেহমানদের গোসলের জন্য। পুকুরসংলগ্ন মন্দির। মন্দিরে বড় দুটি চূড়া রয়েছে। তা প্রায় ৩০ ফুট উঁচু। এর প্রবেশ দ্বারগুলো খিলান দিয়ে নির্মিত। মন্দিরের মূল কক্ষ বেশ ছোট এবং অন্ধকার। মন্দিরের পাশ ঘেঁষে রয়েছে ছায়াঘেরা শান্ত-শ্যামল আম্রকানন। গাছগুলো বেশ পুরনো। একই মাপের ঝাঁকরানো গাছ। ডাল-পালা ছড়ানো, অনেকটা ছাতার মতো। অসংখ্য গাছ। প্রায় প্রতিটি আম গাছের গোড়া পাকা করা। এ ছাড়া জমিদার বাড়ির প্রবেশমুখেই রয়েছে সারি সারি ঝাউ গাছ।
 

কোনো ভ্রমণপিপাসু ব্যক্তি এ জমিদারবাড়িটি দেখতে চাইলে ঢাকা থেকে আসতে সময় লাগবে মাত্র ৩০/৪০ মিনিট। বাসে কিংবা সিএনজি অথবা প্রাইভেট কারে করে আসতে পারেন এখানে। রাজধানী ঢাকার সায়েদাবাদ, গুলিস্থান অথবা যাত্রাবাড়ী থেকে যেকোনো পরিবহনে রূপগঞ্জের রূপসী বাস স্ট্যান্ড কিংবা ভুলতা পর্যন্ত। সেখান থেকে সিএনজি অথবা রিকশাযোগে পিচঢালা রাস্তায় সহজেই আসা যায় এ জমিদার বাড়িতে। রাজধানীর ডেমরাঘাট হয়ে উত্তর দিকের রাস্তা ধরে মাঝিনা ঘাট থেকে নৌকায় শীতলক্ষ্যা নদী পার হলেই রূপগঞ্জের জমিদার বাড়ি।