দূষিত পানিতেই বাড়ছে ডায়রিয়া
প্রধান ফটক পার হবার পরেই কাউকে নেওয়া হচ্ছে হুইল চেয়ারে, কাউকে স্ট্রেচারে, কেউবা আবার সিএনজি নিয়েই ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে। কেউ আসছেন ব্যক্তিগত গাড়িতে। আবার কেউ কেউ ঢুকছেন স্বজনের কাঁধে ভর করে।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রর (আইসিডিডিআর,বি) সামনে যেতেই ভিড়। প্রধান ফটকের সামনে রোগীর ভিড়টা চোখে পড়ে। তবে ভেতর থেকে রোগীরা যে সংখ্যায় বেরুচ্ছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ঢুকছে। প্রধান ফটক পার হবার পরেই কাউকে নেওয়া হচ্ছে হুইল চেয়ারে, কাউকে স্ট্রেচারে, কেউবা আবার সিএনজি নিয়েই ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে। কেউ আসছেন ব্যক্তিগত গাড়িতে। আবার কেউ কেউ ঢুকছেন স্বজনের কাঁধে ভর করে।
তবে গত কয়েকদিনে এ চিত্র অনেকটাই গা সওয়া হয়ে গিয়েছে সামনের চা-দোকানিসহ উপস্থিত ব্যক্তিদের। হাসপাতালের সঙ্গের গলিতে বাড়ি মোহাম্মদ হোসেনের। তিনি বলেন, এখানে যদি এক ঘণ্টা বসে থাকেন তাহলেই ডায়রিয়া রোগীর দেখা পাবেন, হাসপাতালের ভেতরে আর যেতে হবে না। কিছুটা স্বগতোক্তির সুরে মোহাম্মদ হোসেন বলেন, কী পরিমাণে ডায়রিয়া রোগী বাড়লো ঢাকায়, কিন্তু এর কারণটা কী?সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত এপ্রিল মাসে দেশে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। কিন্তু এ বছর মার্চের শুরুতেই রোগী বাড়তে শুরু করে আশঙ্কাজনক হারে। এ অবস্থায় রাজধানীতে রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আইসিডিডিআর,বি-র চিকিৎসকসহ অন্যান্য স্বাস্থকর্মীদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাস্তার খাবার, বাসি-পচা খাবার খেলেও ডায়রিয়া হতে পারে। তবে ডায়রিয়া হবার মূল কারণ দূষিত পানি। খাবার পানিসহ নিত্য ব্যবহার্য পানিও হতে হবে বিশুদ্ধ এবং নিরাপদ। কিন্তু কোনওভাবে যদি খাবার পানির লাইনের সঙ্গে সুয়ারেজ লাইনের সংযোগ ঘটে যায় তাহলে পানি হয়ে পড়ে দূষিত।
এদিকে, গত মঙ্গলবার ( ৫ এপ্রিল) এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান বলেছেন, ৫ থেকে ১০ শতাংশ জায়গায় ওয়াসার পাইপ ফাটা থাকে। তবে অভিযোগ পাবার সঙ্গে সঙ্গে সেটা ঠিক করে দেন দাবি করে তিনি বলেন, কিছু জায়গায় সমস্যা হয়। তিনি নগরবাসীকে পানি ফুটিয়ে খাওয়ার পরামর্শ দেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বিশেষজ্ঞ বলেন, ঢাকা শহরে বিভিন্ন ধরণের স্থাপনা নির্মাণ চলছে। রাস্তাঘাট খোড়া হচ্ছে। সেখানে ওয়াসার পানির পাইপ ফেটে গিয়ে সুয়ারেজ লাইনের সঙ্গে মিলে পানি আর বিশুদ্ধ থাকছে না। যার কারণে ঢাকার ভেতরে ডায়রিয়ার রোগী বাড়ছে।
আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে নির্ধারিত বেডের বাইরে স্থাপন করতে হয়েছে দুইটি তাঁবু। এ হাসপাতালে প্রতিবছর এ সময়ে ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হলেও গত ১৬ মার্চ থেকে ডায়রিয়া রোগীর ভিড় বাড়তে থাকে। সেদিন রোগী ভর্তি ছিল এক হাজার ৫৭ জন। এরপর থেকে প্রতিদিনই রোগী বেড়েছে, রোগী কমছেই না। ১৭ মার্চ এক হাজার ১৪১ জন, ১৮ মার্চ এক হাজার ১৭৪ জন, ১৯ মার্চ এক হাজার ১৩৫ জন, ২০ মার্চ এক হাজার ১৫৭ জন, ২১ মার্চ এক হাজার ২১৬ জন, ২২ মার্চ এক হাজার ২৭২ জন, ২৩ মার্চ এক হাজার ২৩৩ জন, ২৪ মার্চ এক হাজার ১৭৪ জন ভর্তি হয়। ২২ মার্চে একদিনের হিসাবে এ হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা ছিল রেকর্ড।
এরপর ২৫ মার্চে এক হাজার ১৩৪ জন, ২৬ মার্চে এক হাজার ২৪৫ জন, ২৭ মার্চে এক হাজার ২৩০ জন। ২২ মার্চের রোগী সংখ্যার রেকর্ড ভেঙ্গে যায় ২৮ মার্চে। সেদিন একদিনে ভর্তি হয় এক হাজার ৩৩৪ জন। এরপর ২৯ মার্চ ৩১৭ জন, ৩০ মার্চ এক হাজার ৩৩১ জন আর ৩১ মার্চে রোগী ভর্তি হয় এক হাজার ২৮৫ জন। ১ এপ্রিলে এক হাজার ২৭৪ জন, ২ এপ্রিলে এক হাজার ২৭৪ জন, ৩ এপ্রিল এক হাজার ১৭১ জন, ৪ এপ্রিল এক হাজার ৮৩ জন, ৫ এপ্রিল এক হাজার ৩৭৯ জন আর গত বুধবার (৬ এপ্রিল) বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে ৯৬১ জন রোগী। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, রোগী সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে একদিনে হাসপাতালে ভর্তি রোগী সংখ্যার নতুন রেকর্ড হবে।
এদিকে, ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী বাড়ছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, আমরা সংবাদ পাচ্ছি—গ্রীষ্ম আসার আগেই পুরো দেশে ডায়রিয়া রোগী বেড়েছে। বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীতে রোগী বেড়েছে বেশি। তিনি আরও বলেন, ডায়রিয়াজনিত রোগ বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। আমরা একে মোকাবিলা করতে চাই। তিনি জানান, ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে এ রোগে আক্রান্ত ঢাকা জেলায় রোগী ছিল পাঁচ হাজার ৬৭৩ জন আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে ছয় হাজার ৫৮৯ জন। ২০২১ সালের মার্চে রোগী ছিল ছয় হাজার ৫৮৭ জন আর চলতি বছরের মার্চে সাত হাজার একজন। আর সারাদেশে মার্চে ডায়রিয়াতে ভর্তি রোগী ছিল এক লাখ ৭০ হাজার ২৩৭ জন। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর গত তিন বছরের ডায়রিয়া সংক্রান্ত সব রিপোর্ট এক সঙ্গে করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, তাতে অস্বাভাবিক অতিবৃদ্ধি নাই। তবে রোগী বৃদ্ধির যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা আইসিডিডিআর,বি-র হাসপাতালে। বাকি হাসপাতালগুলোতে একই রকম। তবে রোগী সংখ্যা বেড়েছে-এটা ঠিক।
অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, বৃষ্টি ভালো করে হয়নি, পানির লেয়ার নিচে রয়েছে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে বিশুদ্ধ পানির অভাব রয়েছে। সেই সঙ্গে আমাদের নিত্যদিনের জীবন যাপনে যে পানি ব্যবহার করা হয় সেই পানি ততটা জীবাণুমুক্ত বা বিশুদ্ধ না। কাজেই কন্টামিনেশনের ( দূষণ) অন্যতম কারণ কিন্তু এইগুলোও”। তিনি বলেন, খাবার পানির বিষয়টা তো আমরা দেখি না, এটা স্থানীয় সরকার দেখে। তারা নিশ্চয়ই সেটা দেখছে। সবকিছু মিলিয়ে কাজ করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসার কারণ নেই। ফুড পয়জনিং, খাবারের মান খারাপ হলে ডায়রিয়া হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, ডায়রিয়া হবার মূল কারণ দূষিত পানি। শতভাগ নিরাপদ পানি না দেওয়া গেলে ডায়রিয়ার হাত থেকে মুক্তি নেই। “ডায়রিয়ার জীবাণু সংক্রমণ ছাড়া ডায়রিয়া হওয়া কিছুটা অসম্ভব”।
অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, হাত সাবান দিয়ে ধোওয়ার পর কলের মুখ বন্ধ করা হয়। সেই মুখটি বন্ধ করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার হাত জীবাণুমুক্ত। কিন্তু আমার আগে যদি সেই কলের মুখ কোন আক্রান্ত ব্যক্তি ছুঁয়ে যায়, তাহলে ধরার পর আমিও ওই জীবাণুতে আক্রান্ত হয়ে পড়ব। আর এ জীবাণুর ইনকিউবিশন পিরিয়ড দুই ঘণ্টা থেকে পাঁচদিন, বলেন তিনি। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, যতক্ষণ পর্যন্ত না শতভাগ বিশুদ্ধ পানি দেওয়া না যাবে, সেটা খাবারের পানি হোক আর নিত্য ব্যবহারের হোক—ততক্ষণ পর্যন্ত ডায়রিয়া থেকে আমাদের রেহাই নেই, বলেন ডা. নাজমুল ইসলাম। তবে ডায়রিয়া রোগীদের চিকিৎসা যত দ্রুত সম্ভব দিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের সব সরকারি হাসপাতালে এ রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে। বরং কাছের হাসপাতালে চিকিৎসা না নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হলেই রোগীর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। তাই ডায়রিয়া দেখা দিলে দ্রুততার সঙ্গে কাছের হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।