Ad0111

ডেল্টা লাইফে ৩ হাজার কোটি টাকার ‘অনিয়ম’

দেশের জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে সব থেকে বড় প্রতিষ্ঠান ডেল্টা লাইফ। তবে দীর্ঘদিন ধরেই কোম্পানিটির মালিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। সম্প্রতি বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাও ডেল্টা লাইফের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে।

ডেল্টা লাইফে ৩ হাজার কোটি টাকার ‘অনিয়ম’
ফাইল ফটো

প্রথম নিউজ, ঢাকা: শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে বলে বিশেষ অডিটে উঠে এসেছে। বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) থেকে কোম্পানিটিতে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার পর নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান একনাবিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস দিয়ে এই অডিট করা হয়েছে।

তবে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের অডিট রিপোর্টের তথ্য সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন ডেল্টা লাইফের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আদিবা রহমান। তার অভিযোগ, ডেল্টা লাইফে প্রশাসক বসানোর উদ্দেশ্য ছিল আমাদের বিরুদ্ধে কিছু মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে আসা। এখন আইডিআরএকে ডিফেন্স করার জন্য প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে।

দেশের জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে সব থেকে বড় প্রতিষ্ঠান ডেল্টা লাইফ। তবে দীর্ঘদিন ধরেই কোম্পানিটির মালিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। সম্প্রতি বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাও ডেল্টা লাইফের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে তিন ডজন মামলার ঘটনাও ঘটেছে। ডেল্টা লাইফের মালিকদের একটি অংশের সঙ্গে আইডিআরএর দ্বন্দ্বের জেরে প্রায় এক বছর ধরে প্রশাসক দিয়ে চলছে এই জীবন বিমা কোম্পানিটি।

আইডিআরএ এবং ডেল্টা লাইফের মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয় ২০২০ সালে। ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর সিইও হিসেবে পুনর্নিয়োগের আবেদন করেন আদিবা রহমান। কিন্তু ১৬ নভেম্বর তার আবেদন বাতিল করে আইডিআরএ।

এরপর একই বছরের ৮ ডিসেম্বর ডেল্টা লাইফের পক্ষ থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ করা হয় আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেন ৫০ লাখ টাকা ঘুস দাবি করেছেন। দুদকে অভিযোগ করার পর ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করেও একই অভিযোগ করা হয়। ওই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ডেল্টা লাইফের সাবেক সিইও আদিবা রহমান।

ডেল্টা লাইফ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে এমন অভিযোগ করার এক সপ্তাহের মাথায় ১১ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটিতে প্রশাসক নিয়োগ দেয় আইডিআরএ। আইডিআরএর সাবেক সদস্য সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লাকে প্রথম প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। চার মাস না যেতেই গত বছরের জুনে তার নিয়োগ বাতিল করে নতুন প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। দ্বিতীয় প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয় সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব মো. রফিকুল ইসলামকে।

তবে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে গত বছরের ১০ অক্টোবর প্রশাসক পদ থেকে পদত্যাগ করেন মো. রফিকুল ইসলাম। এরপর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে জীবন বিমা কোম্পানিটিতে তৃতীয় প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। এ দফায় প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান আইডিআরএর আরেক সাবেক সদস্য মো. কুদ্দুস খান। ডেল্টা লাইফে এ প্রশাসক নিয়োগ নিয়েও আদালতে মামলা চলমান। এর মধ্যেই সম্প্রতি ডেল্টা লাইফের বিষয়ে আইডিআরএর কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেন প্রশাসক মো. কুদ্দুস খান। এ প্রতিবেদনে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে ডেল্টা লাইফে বিভিন্ন অনিয়ম সংঘটিত হওয়ার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিভিন্ন উপায়ে ডেল্টা লাইফে দুই হাজার ৯১৭ কোটি ৮২ লাখ ৭১ হাজার টাকা অনিয়মের তথ্য তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে আইডিআরএ। এর মধ্যে ম্যানুপুলেশনের মাধ্যমে দাবির প্রভিশন কম দেখিয়ে অতিরিক্ত লভ্যাংশ নেওয়ার মাধ্যমে কোম্পানির দুই হাজার ৫১৩ কোটি ৮৪ হাজার টাকা ক্ষতির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

এছাড়া ভুয়া এজেন্ট কমিশন এবং জাল ভাউচারের মাধ্যমে পাঁচ কোটি ১৪ লাখ ৬২ হাজার টাকা আত্মসাৎ করার কথা বলা হয়েছে। ডেল্টা লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমানের ব্যক্তিগত কোম্পানি ‘রোমা টি’-তে ডেল্টা লাইফের ১৪ লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্যের গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছে। ওই গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হয়েছে ৯০ লাখ ১৩ হাজার টাকা। কিছু কর্মকর্তা মঞ্জুরুর রহমানের ব্যক্তিগত কোম্পানিতে কাজ করলেও বেতন নিয়েছেন ডেল্টা লাইফ থেকে। এতে চার কোটি ৪২ লাখ ৭৮ হাজার টাকার অনিয়ম হয়েছে।

ডেল্টা লাইফে আরও যেসব অনিয়ম পেয়েছে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান-
>> বিমা আইন পরিপন্থি ট্রাস্ট গঠনের মাধ্যমে কোম্পানির ৭৮ লাখ টাকার ফান্ড স্থানান্তর।
>> এক কোটি ৪৮ লাখ ৯৭ হাজার টাকার ক্যাশ ব্যালেন্স ফেব্রিকেশন।
>> হিসাবভুক্ত না করে বিভিন্ন ব্যক্তিকে নগদ প্রদান ও ৮৮ লাখ ৪ হাজার টাকা সন্দেজনক লেনদেন।
>> পরিচালক বিদেশ ভ্রমণের মাধ্যমে কোম্পানির এক কোটি ১০ লাখ ৬ হাজার টাকা অপচয় করেছেন।
>> কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া সিইওর ১৫ লাখ ৯৪ হাজার টাকা বেতন গ্রহণ।
>> আইটি সিস্টেম কিনে কোম্পানির তিন কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার টাকা ক্ষতিসাধন।
>> আয়কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য ব্যবস্থাপনা ব্যয়কে ভুল খাতে হিসাবভুক্ত করা ও আয়কর বকেয়া ৩৮৫ কোটি ৭২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।
>> বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে আরোপ করা ব্যক্তিগত জরিমানা বাবদ ছয় লাখ ৮৬ হাজার টাকা কোম্পানি থেকে প্রদান।
>> ডিলিস্টেড এবং ওটিসি শেয়ার কিনে আর্থিক ক্ষতি, শেয়ারের ক্লোজিং ব্যালেন্সের গড়মিল এক কোটি ৩৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা।

এদিকে ডেল্টা লাইফের প্রশাসক সম্প্রতি এক চিঠিতে আইডিআএর চেয়ারম্যানকে একনাবিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টসের বিশেষ নিরীক্ষার বিষয়ে অবহিত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ডেল্টা লাইফে নিয়ে বিশেষ নিরীক্ষার অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে তিন হাজার ৬৮৭ কোটি টাকার অনিয়ম, অসঙ্গতি, আত্মসাতের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এখন একনাবিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টসের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার ব্যাপক অনিয়ম, অসঙ্গতি, আত্মসাতের সুস্পষ্ট আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে। ১৫৪টি গুরুতর অডিট আপত্তির মধ্যে ৩৫টির নিরীক্ষা সম্পন্ন করে একনাবিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস। ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর এ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ডেল্টা লাইফের সাবেক সিইও আদিবা রহমান বলেন, একনাবিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস এখনো চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়নি। তারা প্রভিশনাল রিপোর্ট দিয়েছে। সেটা আদালতে জমা দেওয়া হয়েছিল, আমরা দেখেছি। সেখানে তারা কোনো আত্মসাতের বিষয়ে বলেননি। তারা বলেছেন, আমরা এসব বিষয় দেখেছি, আমাদের আরও খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি বলেন, ডেল্টা লাইফের লাইফ ফান্ড চার হাজার কোটি টাকা, সেখানে তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা কীভাবে আত্মসাৎ হতে পারে। কারণ আমাদের তো এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার ওপরে সরকারি সিকিউরিটিজে আছে। দেড় হাজার কোটি টাকার মতো এফডিআর আছে। ক্যাপিটাল মার্কেটে এক হাজার কোটি টাকার ওপরে আছে। তিনটা বিল্ডিং আছে। এগুলো যোগ করলেই তো চার হাজার কোটি টাকা মিলে যাবে। এখানে আত্মসাৎটা কীভাবে হলো?

আদিবা রহমান আরও বলেন, ডেল্টা লাইফে প্রশাসক বসানোর উদ্দেশ্য ছিল আমাদের বিরুদ্ধে কিছু মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে আসা। এখন আইডিআরএকে ডিফেন্স করার জন্য প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে। ১১ মাসে (প্রশাসক দায়িত্ব নেওয়ার পর) আড়াই কোটি টাকা লিগ্যাল বিল বাবদ কোম্পানি থেকে বের করেছে। যে শুনানিতে কোম্পানি পার্টিই না, সেখানে তো কোম্পানি টাকা খরচ করতে পারে না। এখানে আইডিআরএর সঙ্গে শেয়ারহোল্ডারদের মামলা। সেখানে কোম্পানি ব্যয় করবে কেন? এটা কার বিল কে দিলো?

এসব বিষয়ে কথা বলতে ডেল্টা লাইফের প্রশাসক মো. কুদ্দুস খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, অডিটর নিয়োগ দিয়েছে আইডিআরএ। এ বিষয়ে আইডিআরএ ভালো বলতে পারবে। আমাদের পক্ষ থেকে বলতে পারি, আইন অনুযায়ী যে পদক্ষেপ নেওয়া যায় তা নেওয়া হবে। আইডিআরএ চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনকি মোবাইলে মেসেজ দেওয়া হলেও তার কোনো উত্তর মেলেনি।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

This site uses cookies. By continuing to browse the site you are agreeing to our use of cookies & privacy Policy from www.prothom.news