ডেঙ্গু আক্রান্ত গর্ভবতী মায়ের আকুতি ‘আমি না বাঁচলেও আমার গর্ভের সন্তানটা যেন বাঁচে’
প্রথম নিউজ, ঢাকা : মিরপুর ১৪ এলাকার বাসিন্দা শারমিন আক্তার ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গত চার দিন শরীরে জ্বর ছিল। প্রথমে সাধারণ জ্বর মনে করে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। কিন্তু গর্ভের সন্তানের নড়াচড়া কমে আসায় দ্রুত হাসপাতালে আসেন তিনি। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসক তার অবস্থা সংকটাপন্ন বলে জানান। এ কথা শোনার পর থেকেই অনাগত সন্তানকে নিয়ে চিন্তায় তিনি। বারবার বলছেন, ‘আমি না বাঁচলেও যেন আমার গর্ভের শিশুটা বাঁচে’।
মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) সকালে সাড়ে ১০টায় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে কথা হয় শারমিন আক্তারের।
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘চারদিন যাবত জ্বর, তবে গতকাল থেকে জ্বর নেই। জ্বর আসার পর আমি আমার সন্তানের নড়াচড়া কম অনুভব করি। এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এরপর দ্রুত পার্শ্ববর্তী একটা হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। সেখানে ডেঙ্গু পরীক্ষা করার পর পজিটিভ এসেছে।’
শারমিন আক্তার বলেন, ‘শুরু থেকে বাসাতেই ছিলাম, কিন্তু পজিটিভ আসার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখি যে প্লাটিলেটও কমে আসছে। ডাক্তার দেখানোর পর তিনি জানান যে, পরিস্থিতি নাকি ভয়াবহ। যে কারণে আমাকে তারাও সেখানে রাখেনি, দ্রুত অন্যকোন হাসপাতালে এসে ভর্তি হতে বলে। এরপর খোঁজ নিয়ে এই হাসপাতালে আসি।’
তিনি বলেন, ‘জ্বরের শুরুর দিনেই অনেক তাপমাত্রা ছিল। সাথে প্রচণ্ড বমি। এখন ৯ মাস চলছে। আগামী ৮ সেপ্টেম্বর ডেলিভারির ডেট। বিভিন্ন জন ডেঙ্গু নিয়ে ভয়ের কথা বলছিল। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গর্ভবতী মায়েদের খবরও প্রতিদিন পাচ্ছি। সবমিলিয়ে খুবই ভয়াবহ অবস্থায় পড়ে গেছি। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, প্রয়োজনে আমাকে যেন তিনি নিয়ে যান, তবুও যেন আমার সন্তানের কোনো ক্ষতি না হয়। তার কিছু হলে আমি মেনে নিতে পারব না। আমি মরে গেলেও যেন আমার সন্তানটা বেঁচে থাকে।’
গর্ভবতী এ নারী বলেন, ‘গত দুইদিন ধরে খুবই ভয় হচ্ছে বাচ্চাটাকে নিয়ে। রাতে ঘুমাতেও পারি না। এটাই আমার প্রথম সন্তান। যখন শুনেছি রক্তের প্লাটিলেট কম আসছে, তখন আর নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি। সারাক্ষণ একটা চিন্তা থাকেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘পেটে বাচ্চা আসার পর থেকেই তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখছি। খেয়ে না খেয়ে হলেও আমি তাকে মানুষের মতো মানুষ বানাব। বাচ্চার যখন নড়াচড়া অনুভব করতাম তখন খুবই আনন্দ লাগত। কিন্তু জ্বর হওয়ার পর বাচ্চার নড়াচড়া না পেয়ে আমি পাগলের মতো হয়ে গেছি। তবে এখন আবার নড়াচড়া টের পাচ্ছি।’
প্লাটিলেট কমে আসার খবরে মনে ভয় ঢুকে গেছে
গর্ভবতী মেয়ের ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার খবরে মাদারীপুর সদর উপজেলার ধুরাইল থেকে ঢাকায় এসেছেন রত্না বেগম। সন্তানের পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রথম দুইদিন একটু জ্বর বেশি ছিল। এরপর থেকে কিছুটা কম। জ্বর কমলেও পরে যখন ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়েছি, তখন ডেঙ্গু ধরা পড়ে। ডাক্তার বলেছেন, প্লাটিলেটও কমে গেছে। তখনই আমাদের মনে ভয় ঢুকে গেছে। এরপর দ্রুত তাকে আল মানার হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু অবস্থা একটু বেশি খারাপ হওয়ায় সেখানে তাকে রাখা হয়নি।’
রত্না বেগম বলেন, ‘গতকাল সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। এখন পর্যন্ত অবস্থার কোন উন্নতি দেখছি না। আল্লাহর কাছে সবসময় দোয়া করছি যেন আমার মেয়ের কিছু না হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আজসহ দুইদিনে ডাক্তার এসে দুইবার দেখেছে। তবে এই ওয়ার্ডে নির্দিষ্ট কোনো ডাক্তার নেই। ফলে কোন সমস্যা হলেই দৌড়াদৌড়ি শুরু করতে হয়। এখানে যদি পার্মানেন্টলি একজন ডাক্তার থাকেন, তাহলে মনেও একটা সাহস থাকত।’
যা বলছেন কর্তব্যরত স্বাস্থ্যকর্মী
সিনিয়র স্টাফ নার্স নুসরাত জাহান বলেন, শারমিন আক্তারের শারীরিক অবস্থা ভালো, এখনও এমনটা বলা যাচ্ছে না। তার বুকে এখনও ব্যথা আছে। এ মুহূর্তে তার প্লাটিলেট আছে ৩৫ হাজারের মতো। আশা করছি, দ্রুতই তিনি রিকভারি করবেন। তাকে আমরা অন্য রোগীদের তুলনায় একটু বিশেষ কেয়ারে রেখেছি।
তিনি বলেন, গর্ভ অবস্থায় ডেঙ্গু রোগীদের একটু ঝুঁকি থাকেই। সব সময় আমরা চেষ্টা করি তাদের একটু স্পেশাল সেবা দেওয়ার। গত কিছুদিনে আমরা আরও কয়েকজন গর্ভবতী ডেঙ্গু রোগী হ্যান্ডেল করেছি। প্রায় সবারই সিচুয়েশন একটু খারাপের দিকে চলে গিয়েছিল। তবে আল্লাহর রহমতে এখন পর্যন্ত কোনো গর্ভবতী নারীর মৃত্যু হয়নি।
তিনি বলেন, গত সপ্তাহ আগেও আমাদের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে কোনো সিট ফাঁকা ছিল না। এখন সংক্রমণ কিছুটা কমে আসায় বেশ কিছু সিট ফাঁকা আছে। আমরা এই ওয়ার্ডে সবমিলিয়ে ৪০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করতে পারি। তবে এ মুহূর্তে ২২ জন রোগী ভর্তি আছেন।
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে গর্ভবতীরা
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. লোহানি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকেন গর্ভবতী মা এবং শিশুরা। এবার তাদের আক্রান্তের হারটা বেশি। ইতিমধ্যে বেশকিছু মৃত্যুও ঘটেছে। কারণ হলো গর্ভবতী নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক কম। ফলে কোনো গর্ভবতী নারী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে সাধারণ রোগীদের তুলনায় তারা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। ভাইরাসটি দ্রুত মায়ের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অনেকটাই কমেছে। তবে ১০ জন রোগী ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে আসলে অন্তত ৫ জনেরই ডেঙ্গু পজিটিভ পাচ্ছি। আবার এমন কিছু রোগী পাচ্ছি যাদের ডেঙ্গু পজিটিভ আসছে না, কিন্তু প্লাটিলেট কমে আসছে। এরকম রোগীদেরও আমরা ডেঙ্গু পজিটিভ ধরেই চিকিৎসা দিচ্ছি।
ক্রিটিক্যাল রোগী কেমন পাওয়া যাচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ক্রিটিকাল পরিস্থিতিটা নির্ভর করছে রোগী হাসপাতালে কততম দিনে আসছে সেটার ওপর। সকাল ১০টা পর্যন্ত আমি দুজন রোগীকে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তির জন্য পাঠিয়েছি, তাদের দুজনেই দেরি করে হাসপাতালে এসেছে। একজন এসেছে ৬দিন পর। তার প্লাটিলেট কাউন্ট পেয়েছি ১০ হাজার। আরেকজন এসেছে ৪দিন পর, তার প্লাটিলেট কাউন্ট পেয়েছি ১৩ হাজার। তাদের অবস্থা কিছুটা ক্রিটিক্যালই দেখেছি।