ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল করল ভারত

চিকেন নেক নিয়ে নিরাপত্তাহীনতাই কারণ—মত বিশ্লেষকদের, বাণিজ্যে প্রভাব পড়বে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও মায়ানমারের ওপর, ডব্লিউটিওতে নালিশের সুযোগ আছে বাংলাদেশের,

ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল করল ভারত

প্রথম নিউজ, অনলাইন:   বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্কর্কের টানাপড়েনের মধ্যে আকস্মিক দেশটি বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে। শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়াকে কেন্দ্র করে কয়েক মাস ধরে উভয় দেশের শীতল সম্কর্ক আর ‘চিকেন নেক’ নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে অনেকটা নীরবেই ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের কথা জানায় ভারত। এতে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে চলমান বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হলেও মূলত নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েই ভারত তা বাতিল করেছে।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের ফলে বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করলেও এমনটি মনে করছেন না ব্যবসায়ীরা। তবে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও উল্লেখ করেছে, ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল করা ভারতীয় ভূখণ্ড দিয়ে নেপাল, ভুটানে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। এর পরও বাংলাদেশ এটিকে বাধা হিসেবে দেখলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) অভিযোগ জানাতে পারে।  এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ কাস্টমস নীতির সাবেক সদস্য ড. রশিদ উল আহসান চৌধুরী  বলেন, “ভারতের ভেতর দিয়ে নেপাল ও ভুটানকে দেওয়া ট্রানজিট বাতিল করার বিষয়টিতে বাংলাদেশ ও নেপাল-ভুটানের বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে সন্দেহ নেই।
তবে এর চেয়েও বড় যে বিষয় সেটি হলো—আমার ধারণা ভারত এখানে নিরাপত্তার স্বার্থে এটা বাতিল করে থাকতে পারে। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে ‘চিকেন নেক’ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। এসব আলোচনা থেকে হয়তো দেশটি তাদের নিরাপত্তা ইস্যুটিকে বড় করে দেখছে। এ সিদ্ধান্ত সাময়িক হতে পারে।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে উন্নতি হলে হয়তো ট্রান্সশিপমেন্ট আবারও চালু করে দিতে পারে।’

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিউটিওর আর্টিকেল ১১ পর্যালোচনা করে জানা যায়, ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন অ্যাগ্রিমেন্ট বা টিএফএ বলছে, ল্যান্ডলকড দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য প্রসারের স্বার্থে নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য নয়। এটা করা হলে ওই সব দেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।

ভারতের দিক থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের বিষয়টি ডব্লিউটিওর নীতিমালাবিরোধী হলেও বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানের সঙ্গে করা চুক্তিতে এ ধরনের চুক্তি বাতিলের সুযোগ রাখা আছে কি না, তা পর্যালোচনা করলে জানা যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা জানান।

জানা যায়, গত ৮ এপ্রিল ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস এই সুবিধা বাতিল করে আদেশ জারি করেছে।
এর পাশাপাশি ২০২০ সালের ২৯ জুন দেওয়া এসংক্রান্ত আদেশও বাতিল করা হয়। ২০২০ সালের পর থেকে ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল, ভুটান ও মায়ানমারে পণ্য আনা-নেওয়া শুরু করে বাংলাদেশ।

ভারত সরকার এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে এই ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের পণ্য নিয়ে নেপাল, ভুটান, মায়ানমারগামী গাড়িগুলোকে মালপত্র খালাস করে দ্রুত বাংলাদেশে ফিরে যেতে বলা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় একাধিক গণমাধ্যম বলছে, ভারত সুবিধা প্রত্যাহার করে নেওয়ায় বাংলাদেশের এখন নেপাল, ভুটানে পণ্য পাঠাতে হলে আকাশপথ ব্যবহার করা ছাড়া উপায় থাকবে না। তাতে খরচ অনেক বেশি হবে। এ ছাড়া এসব দেশের মধ্যে কার্গো বিমান খুব কম চলাচল করে। ফলে নেপাল, ভুটানে বাংলাদেশ সহজে পণ্য পাঠাতে পারবে না।

সম্প্রতি আমেরিকার বাংলাদেশের পণ্যের ওপর শুল্ক চাপানোর বিষয়টি যখন টক অব দ্য কান্ট্রি, ঠিক ওই সময় ভারতের দিক থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের ঘটনা বাংলাদেশের বাণিজ্যক্ষেত্রে আরেকটি ধাক্কা বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

জানা যায়, ভারতের স্থলসীমান্ত দিয়ে নেপাল, ভুটান ও মায়ানমারের বিপুল পরিমাণ তৈরি পোশাক, মাছসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য, ফল আমদানি-রপ্তানি হয়। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বহুদিন ধরে বাংলাদেশের এই সুবিধা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প ভারতের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। এদিকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারত সরকার উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে পণ্য সরবরাহ করে থাকে। বাংলাদেশ এখন সেই সুবিধা প্রত্যাহার করে নেবে কি না সেটাই এখন দেখার।

ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল করায় বাংলাদেশের বাণিজ্যে প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ  বলেন, ‘বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন শ্রীলঙ্কার পোর্ট কলম্বো ও সিঙ্গাপুর বন্দর। ভারতের কোনো বন্দর তেমন একটা ব্যবহার করেন না। আর নেপাল ও ভুটানে আমাদের পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয় সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা সমমূল্যের। এ ছাড়া ২০২০ সালের জুন থেকে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ভারতের কলকাতা এয়ার কার্গো কমপ্লেক্স ব্যবহার করে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা পেয়ে আসছিলেন। কিন্তু সেখানে ফ্লাইটের সংখ্যা কম হওয়ায় বাণিজ্য করিডরের পুরো সুবিধা নেওয়া সম্ভব হয় না বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের। সুতরাং ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল করার ফলে বাংলাদেশের তেমন একটা ক্ষতি হবে না।’

তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট ব্যবহার করে এখনো নেপাল-ভুটানে তৈরি পোশাক রপ্তানি শুরু হয়নি। তবে সামান্য তুলা কাপড় আমদানি হয়। এটাতে তৈরি পোশাকে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, ‘বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে যে ব্যবসা, সেটা এখনো বড় আকারে গড়ে ওঠেনি। এর পরও বাংলাদেশের আশপাশের দেশগুলোর ব্যবসা প্রসারের যে সুবিধা নেওয়ার পরিকল্পা ছিল, সেটাতে হয়তো পরিবর্তন আসতে পারে। কারণ মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ও চট্টগ্রাম বন্দরের বে টার্মিনাল প্রকল্পে যাঁরা ব্যবসা করবেন, তাঁরা চাইবেন দুই বন্দর ব্যবহার করে পাশের অঞ্চলগুলোতেও সুবিধা নেওয়ার। এখন ওই সব সুবিধা বন্ধ হচ্ছে কি না সেটা দেখার বিষয়। তাহলে আগামী দিনে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের প্রভাব পড়তে পারে।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের ভূমিবেষ্টিত প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্যে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) অভিযোগ জানানো সম্ভব। ডব্লিউটিওর নিয়ম অনুযায়ী, সদস্য দেশগুলোকে ভূমিবেষ্টিত দেশগুলোর পণ্যের জন্য অবাধ ট্রানজিট নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অপ্রয়োজনীয় বিলম্ব বা শুল্ক না থাকে। ভারত নিয়ম লঙ্ঘন করলে বাংলাদেশের পক্ষে ডব্লিউটিওতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করার অধিকার রয়েছে। ডব্লিউটিওর বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রথমে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার চেষ্টা করতে পারে। যদি তাতে সমাধান না হয়, তবে বাংলাদেশ বিষয়টি ডব্লিউটিওর বিরোধ নিষ্পত্তি সংস্থার (ডিএসবি) কাছে উত্থাপন করতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে প্রমাণ করতে হবে, ভারত সুনির্দিষ্টভাবে ডব্লিউটিওর নিয়ম ভঙ্গ করেছে এবং বাধার ধরনটি অযৌক্তিক বা বৈষম্যমূলক। উদাহরণস্বরূপ—ভারত যদি নিরাপত্তার কারণে বা যুক্তিসংগত প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার জন্য বাধা দেয়, তবে তা ডব্লিউটিওর নিয়মের আওতায় বৈধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। কিন্তু যদি বাধাটি অযৌক্তিক বা বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী হয়, তাহলে বাংলাদেশের অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশে প্রদত্ত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার ফলে ভারতের বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরগুলোতে দীর্ঘ সময় ধরে যানজট তৈরি হচ্ছে। লজিস্টিক বিলম্ব এবং উচ্চ ব্যয় তাদের রপ্তানিকে বাধাগ্রস্ত করছে। তাই ৮ এপ্রিল ২০২৫ থেকে এই সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ভারতের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের তৃতীয় দেশে রপ্তানি পণ্যসম্ভার নিয়ে যাওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করা হয়েছে, যা একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এই সিদ্ধান্ত ভারতীয় বন্দর এবং বিমানবন্দরগুলো দিয়ে পণ্য পরিবহনের ওপর প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশের রপ্তানি কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য বাধা সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে ভুটান, নেপাল ও মায়ানমারের বাজারে। এই সুবিধা বাণিজ্য সহজতর করতে এবং খরচ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তাই আকস্মিক এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য লজিসটিক্যাল চাপ বাড়াতে পারে, যা আঞ্চলিক বাজারে এর প্রতিযোগিতামূলকতা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

তিনি আরো বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশের শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদারদের মধ্যে একটি। এই নীতিগত পরিবর্তন ভবিষ্যতে উভয় দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সংগতিপূর্ণ নয়। আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি যে ভারত তার অবস্থান পুনর্বিবেচনা করবে এবং উভয় দেশের জন্য উপকারী একটি সমাধান বের করতে আলোচনায় বসবে।’

ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে দেশের বাণিজ্যে কোনো প্রভাব পড়বে না : বাণিজ্য উপদেষ্টা

ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে দেশের বাণিজ্যে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন। গতকাল কারওয়ান বাজারের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) কার্যালয়ে বৈঠক শেষে তিনি এ কথা জানান। বাতিল ইস্যুতে জরুরি বৈঠক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য উপদেষ্টার সভাপতিত্বে বৈঠকে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শেষে বাণিজ্য উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, নেপাল ও ভুটানে রপ্তানির যে প্রক্রিয়া তাতে এ সিদ্ধান্তে কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে সরকার তৈরি পোশাক রপ্তানিসহ সার্বিক বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। আজ বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে একটি আন্ত মন্ত্রণালয় বৈঠক হবে। সেখানে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।