ঝুঁকি নিয়েই চলছে ৩২ লঞ্চ

লঞ্চগুলো মূলত সানকেন ডেক বিশিষ্ট ও আকারে ছোট হওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। তবে এই ঘোষণার এক মাস পর থেকে তিন দফায় সানকেন ডেকের ৩২টি লঞ্চ চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

ঝুঁকি নিয়েই চলছে ৩২ লঞ্চ
নারায়ণগঞ্জে তিন দফায় পাঁচটি রুটে ঝুঁকিপূর্ণ আখ্যা দেওয়া ৩২টি লঞ্চ চালু

প্রথম নিউজ, নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে গত ২০ মার্চ কার্গো জাহাজ রূপসী-৯ এর ধাক্কায় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমএল আফসার উদ্দিন ডুবে ১০ জনের মৃত্যু হয়। সেই সময় সানকেন ডেক লঞ্চগুলো ঝুঁকিপূর্ণ আখ্যা দিয়ে বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এরপর তিন দফায় পাঁচটি রুটে ঝুঁকিপূর্ণ আখ্যা দেওয়া ৩২টি লঞ্চ চালু করা হয়েছে। 

লঞ্চগুলো মূলত সানকেন ডেক বিশিষ্ট ও আকারে ছোট হওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। তবে এই ঘোষণার এক মাস পর থেকে তিন দফায় সানকেন ডেকের ৩২টি লঞ্চ চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এতে প্রশ্ন উঠছে—এক বছর ধরে ঝুঁকিপূর্ণ থাকা এই লঞ্চগুলো দিয়ে যাত্রী চলাচল কতটা নিরাপদ? যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম এসব লঞ্চে চলাচলকে বেশ বিপজ্জনক বলছে। তবে নৌ-পরিবহন অধিদফতরের সার্ভে অনুযায়ী, লঞ্চগুলোকে চলাচলের যোগ্য বলে দাবি করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ থেকে পাঁচটি রুটে মোট ৭০টি লঞ্চ চলাচল করে। রুটগুলো হলো—নারায়ণগঞ্জ-চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ- মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ-রামচন্দ্রপুর, নারায়ণগঞ্জ-নড়িয়া ও নারায়ণগঞ্জ-মতলব।

এসব রুটি দিয়ে দৈনিক প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার যাত্রী চলাচল করে। ২০ মার্চ দুর্ঘটনার পরে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। ওই সময় রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে বড় ও হাইডেকের চারটি লঞ্চ চালু করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পর নারায়ণগঞ্জের বন্ধ থাকা লঞ্চগুলো আবারও চালু করায় যাত্রী সংকটসহ নানা কারণে ওই চারটি লঞ্চ অন্যত্র চলে যায়।

যাত্রীরা বলছেন, ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করে আর দুর্ঘটনার দৃশ্য আরও কেউ দেখতে চান না। কিন্তু যাত্রীদের কথা শোনার কেউ নেই। এ কারণে বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে ছোট লঞ্চে চলাচল করতে হচ্ছে। কিছুদিন আগেও বড় বড় লঞ্চ দেওয়া হয়। ওই লঞ্চগুলো নিরাপদ মনে হয়েছিল। তবে এক মাসের ব্যবধানে আবারও সেই ছোট ও ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চ চালু করা হলো।

যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি বলেন, ‘লঞ্চগুলো চালু করা ভুল হয়েছে। এতে যাত্রীদের আরও ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। প্রতিবারই দেখেছি, দুর্ঘটনার পর মানুষের জানমালের ক্ষতি হলে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে আবার চালু করে। সেই ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চগুলো এখন কীভাবে চলাচল করছে?’

বিআইডব্লিউউটিএ’র নারায়ণগঞ্জ জেলা অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ১৪ জুন জেলার সানকেন ডেকের ১০টি লঞ্চ চালুর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর আগে ২৪ এপ্রিল ১৮টি ও ৩০ এপ্রিল ৪টি সানকেন ডেকের লঞ্চ চালুর অনুমতি দেওয়া হয়। সেই হিসাবে সানকেন ডেক লঞ্চের সংখ্যা বর্তমানে ৩২টি। এসব লঞ্চের দৈর্ঘ্য ৬৫ ফুট থেকে ৭০ ফুটের অধিক। এছাড়া হাইডেক হওয়ায় আগে থেকে একটি লঞ্চের অনুমতি ছিল।

বিআইডব্লিউটিএ’র নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের উপ-পরিচালক (নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক) বাবু লাল বৈদ্য বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর লঞ্চগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এই রুটে চলাচল করতে দেওয়া হয়নি। এখন ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে না তা নয়, তবে যাত্রীদের দুর্ভোগ লাঘবের কথা বিবেচনা করে লঞ্চগুলো চালু করা হয়েছে। তাছাড়া নৌ-পরিবহন অধিদফতর লঞ্চগুলোর সার্ভে দিয়েছে। এ কারণে সেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হলেও চলাচলের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। তবে সানকেন ডেক থেকে হাইডেকে উন্নীত করার জন্য লঞ্চ মালিকদের এক বছর সময় দেওয়া হয়েছে।’
 
যাত্রী চলাচলের জন্য সানকেন ডেক লঞ্চগুলো কতটা নিরাপদ—এ বিষয়ে নৌ-পরিবহন অধিদফতরের ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড শিপ সার্ভেয়ার (নারায়ণগঞ্জ) মোহাম্মদ এহতেছানুল হক ফকির বলেন, ‘সানকেন ডেকের লঞ্চ শুধু নারায়ণগঞ্জ নয়, সারাদেশে চলাচল করে। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটায় এখানকার লঞ্চ নিয়ে কথা উঠেছে। আর দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই। দুর্ঘটনার ভিডিওতে দেখেছেন লঞ্চের উপরে জাহাজ তুলে দিয়েছিল। এক্ষেত্রে যতই ভালো ফিটনেস থাকুক তাতে কাজ হবে না।
 
নৌ-পরিবহন অধিদফতরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড শিপ সার্ভেয়ার মনজুরুল কবীর বলেন, ‘আমরা যখন একটা লঞ্চের সার্ভে রিপোর্ট দিই, তখন সেটা চলাচলের যোগ্য বলেই দিয়েছি। নারায়ণগঞ্জে দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর জন্য শুধু নৌযান দায়ী নয়, চ্যানেলও দায়ী। এই রুটে চট্টগ্রামের বড় বড় জাহাজগুলোও চলাচল করে। সার্ভে রিপোর্টে কী ধরনের পরিবর্তন হয়েছে, যে কারণে বিআইডব্লিউটিএ সানকেন ডেক লঞ্চগুলোকে চলাচলের অনুমতি দিচ্ছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমন কিছু নয়। আমাদের কাজ হচ্ছে ফিটনেস দেওয়া। আমরা সেটাই করছি। তবে এই রুটে কোন ধরনের লঞ্চ চলাচল করবে সেটা বিআইডব্লিউটিএ নির্ধারণ করবে।’

দুর্ঘটনার পরে যে লঞ্চগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ আখ্যা দিয়ে বন্ধ করা হলো, কিছুদিন পরে আবার সেগুলো চালুর অনুমতি পেলো—এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের যুগ্ম পরিচালক শেখ মাসুদ কামাল জানান, সব লঞ্চের অনুমিত দেওয়া হয়নি। নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের কিছু লঞ্চ দেওয়া হয়েছে। এদের নির্দিষ্ট সময় বেধে দেওয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তারা বড় লঞ্চ নামাবে শর্তে লঞ্চ চালু করা হয়েছে। তাছাড়া পরিবর্তন ধীরে ধীরে আনতে হয়, হয় না। যাত্রীদের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে এগুলো চালু করা হয়েছে।’
  
বাংলাদেশ নৌ-পরিবহন (যাত্রী) সংস্থা নারায়ণগঞ্জ জোনের সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চ কী টার্মিনালে চলাচল করতে পারে? সার্ভে করে, পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে লঞ্চ চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়। সার্ভে ছাড়া কোনও লঞ্চ চলাচল করতে পারবে না। সুতরাং এই লঞ্চগুলো শতভাগ নিরাপদ। কোনও ঝুঁকি নেই।’

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom