কার্গো পণ্য পরিবহন চার্জ কমাতে কাজ করছে বিমান-বেবিচক, বাড়ছে দেশের সক্ষমতা

 কার্গো পণ্য পরিবহন চার্জ কমাতে কাজ করছে বিমান-বেবিচক, বাড়ছে দেশের সক্ষমতা

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক:ভারতে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল হওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে স্বনির্ভর হওয়ার জন্য নিয়েছে নানান পদক্ষেপ। পোর্ট হ্যান্ডলিং চার্জ ও কার্গো পরিবহন ভাড়া কমাতে কাজ চলছে। বাড়ানো হচ্ছে চট্টগ্রামের শাহ আমানত ও সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা। ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে সক্ষমতা আরও বাড়বে।

বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সূত্র জানায়, ভারতে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করায় আকাশপথে পণ্য পরিবহনে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চাপ অনেকটা বেড়েছে। এজন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে ওসমানী বিমানবন্দর থেকে কার্গো পণ্য পরিবহনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ২৭ এপ্রিল সিলেট থেকে প্রথম পণ্য ইউরোপ যাবে। এছাড়া চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকেও প্রস্তুত করা হচ্ছে।

২০২০ সালে করোনার সময় ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে কলকাতা বা দিল্লির মতো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশি পণ্য পরিবহন সুবিধা পায় বাংলাদেশ। গত ৮ এপ্রিল বাংলাদেশের এ কার্গো ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে ভারত। ওই সময়টাতে প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির প্রায় ১৮ শতাংশ কার্গো ভারতের বিমানবন্দর দিয়ে পরিবহন করা হতো।

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএফএফএ) তথ্য অনুসারে, ট্রান্সশিপমেন্ট নিষেধাজ্ঞার আগে বাংলাদেশ এক সপ্তাহে প্রায় তিন হাজার ৪শ টন পোশাক এয়ার কার্গোর মাধ্যমে রপ্তানি করতো। এর মধ্যে ৬শ টন পরিবহন করা হতো ভারতীয় বিমানবন্দর দিয়ে। এখন ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধের পর সপ্তাহে প্রায় চার হাজার টন পণ্য দেশ থেকেই রপ্তানি হচ্ছে। এসব পণ্য পাঁচটি এয়ারলাইন্স (এমিরেটস, কাতার, টার্কিশ, সৌদিয়া ও ক্যাথে প্যাসিফিক) সরাসরি কার্গো ফ্লাইট পরিচালনা করছে।

    ওসমানী বিমানবন্দরে আগে থেকেই গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা দিয়ে আসছে বিমান। এখন কার্গো ফ্লাইটে সেবার সব ধরনের প্রস্তুতি আছে। সেখানে কার্গোর ইউরোপিয়ান স্টেশন সম্পূর্ণ প্রস্তুত। প্রথম ফ্লাইটে ৪০ টন মালামাল পাঠানো হবে। পরে সম্ভবত ১ বা ৪ মে পরবর্তী ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে।- বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাফিকুর রহমান

এছাড়া ১৫-১৭টি এয়ারলাইন্স যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের মাধ্যমে কার্গো পরিবহন করছে। ফলে শাহজালাল বিমানবন্দরে কার্গো পরিবহনে তেমন অতিরিক্ত চাপ পড়ে না। তবে রপ্তানির পিক সিজনে অর্থাৎ, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর— এই পরিমাণ এক হাজার থেকে ১২শ টনে পৌঁছে যায়। এ কারণেই এতদিন অতিরিক্ত কার্গো ভার সামাল দিতে ভারতীয় বিমানবন্দরগুলো ব্যবহার করা হতো। ভারত থেকে পণ্য পরিবহনে খরচও কিছুটা কম হতো।
নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে নানান উদ্যোগ

এদিকে আকাশপথে পণ্য পরিবহনের চাপ সামাল দিতে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এরই মধ্যে সংস্থাটি গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজে ব্যবহৃত বেশ কিছু সরঞ্জাম সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরে পাঠিয়েছে। পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে জনবল। রোববার (২৭ এপ্রিল) থেকে এ বিমানবন্দর থেকে কার্গো অপারেশন চালু হবে।

সিলেটের কার্গো টার্মিনাল অত্যাধুনিক উল্লেখ করে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে বিদ্যমান অবকাঠামোর দুই-তিন গুণ বেশি কার্গো পরিচালনা করা যাবে। এর আগে ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে ওসমানী বিমানবন্দরে কার্গো অপারেশন চালু করা হবে।’

ভারতমুখী প্রবণতা কমাতে শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের কার্গো এরিয়ার আয়তন দ্বিগুণ করা হয়েছে। এখন শাহজালাল বিমানবন্দরের বিদ্যমান টার্মিনাল-১ এবং ২ এর সম্মিলিত রপ্তানি কার্গো স্থান ১৯ হাজার ৬শ বর্গমিটার এবং বার্ষিক দুই লাখ টন হ্যান্ডলিং ক্ষমতা রয়েছে। অন্যদিকে, তৃতীয় টার্মিনালের কার্গো এলাকার আয়তন ৩৬ হাজার বর্গমিটার। চালু হলে এখান থেকে প্রতি বছর ৫ লাখ ৪৬ হাজার টন পণ্য হ্যান্ডলিং করা যাবে।

দেশের বিমানবন্দরগুলোতে এককভাবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা দেয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এ সেবা নিশ্চিত করতে গত কয়েক বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকার সরঞ্জাম কিনেছে সংস্থাটি। সবশেষ গত ২৫ মার্চ ৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের ৩২টি ইক্যুইপমেন্ট কমিশনিং করলো বিমান। এছাড়া এ সেবা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদে কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে।

    ইউরোপের কার্গো হ্যান্ডলিং রেট বর্তমানে প্রতি কেজিতে ২ দশমিক ৭০ থেকে ২ দশমিক ৮০ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশের স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হলে শাহজালাল বিমানবন্দরের হারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।- বিএএফএফএ সভাপতি কবির আহমেদ

বিমান সূত্র জানায়, মূলত এসব সরঞ্জাম ও জনবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করার জন্য। কিন্তু এখন ভারতে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করায় কিছু জনবল এবং সরঞ্জাম সিলেটে পাঠানো হয়েছে। আগামী ২৭ এপ্রিল সিলেটে গ্রাউন্ড-হ্যান্ডলিং পরিষেবার প্রস্তুতি চলছে। ওই দিন সেখান থেকে গ্যালিস্টেয়ার এভিয়েশনের এয়ারবাস এ৩৩৩-৩৩৩ মালবাহী প্লেনটির স্পেনে ৪০ টনের বেশি পোশাক পণ্য পরিবহনের কথা রয়েছে।

জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাফিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওসমানী বিমানবন্দরে আগে থেকেই গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা দিয়ে আসছে বিমান। এখন কার্গো ফ্লাইটে সেবার সব ধরনের প্রস্তুতি আছে। সেখানে কার্গোর ইউরোপিয়ান স্টেশন সম্পূর্ণ প্রস্তুত। প্রথম ফ্লাইটে ৪০ টন মালামাল পাঠানো হবে। পরে সম্ভবত ১ বা ৪ মে পরবর্তী ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে।’
স্বনির্ভর হচ্ছে দেশ

ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ করায় সাময়িক সমস্যা হলেও দেশীয় সম্ভাবনাগুলো আলোর মুখ দেখবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহ-সভাপতি খায়রুল কবির সুজন। তিনি সম্প্রতি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এয়ার শিপমেন্টের ক্ষেত্রে বর্তমানে দেশের বিমানবন্দরগুলোতে যেসব সমস্যা রয়েছে, তা সমাধানে এখন আমাদের দেশের নিজস্ব লজিস্টিক সুবিধাগুলো বাড়াতে হবে। সরকার চাইলে কম সময়ের মধ্যে এসব সুবিধা বাড়ানো সম্ভব। বিশেষ করে কার্গো পরিবহনের জন্য এখন দরকার কার্গো প্লেনের ফ্লাইট চালু ও বাড়ানো। এয়ার কার্গো পরিবহন যাতে ব্যয়সাশ্রয়ী হয়, সে বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে ব্যবস্থা নেওয়া।’

ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সেবা বন্ধ রাখায় শাহজালাল বিমানবন্দরে পণ্য পরিবহনে ভাড়া বেড়েছে কি না জানতে চাইলে বিএএফএফএ সভাপতি কবির আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভারতের ওই সিদ্ধান্তের পর শাহজালাল বিমানবন্দরে কোনো প্রকার মনগড়া বা অযৌক্তিক হারে এয়ার ফ্রেইট বাড়ানো হয়নি। বরং, বাস্তবতা হলো শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে পণ্য পরিবহন ভাড়া আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে প্রতিযোগিতামূলক। ইউরোপের কার্গো হ্যান্ডলিং রেট বর্তমানে প্রতি কেজিতে ২ দশমিক ৭০ থেকে ২ দশমিক ৮০ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশের স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হলে শাহজালাল বিমানবন্দরের হারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।’

    এয়ার কার্গো ফ্রেইট ফি বা ভাড়া আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে প্রতিযোগিতামূলক। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সও তাদের কার্গো ভাড়া কমাতে কাজ করছে। বেবিচকও পোর্ট হ্যান্ডেল চার্জ যৌক্তিকভাবে কমাচ্ছে। এতে কার্গো পরিবহনে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমাদের পণ্য আমরাই পরিবহন করবো। কোনো দেশকে পরিবহন করতে হবে না।- বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়া

এ বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এয়ার কার্গো ফ্রেইট ফি বা ভাড়া আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে প্রতিযোগিতামূলক। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সও তাদের কার্গো ভাড়া কমাতে কাজ করছে। বেবিচকও পোর্ট হ্যান্ডেল চার্জ যৌক্তিকভাবে কমাচ্ছে। এতে কার্গো পরিবহনে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমাদের পণ্য আমরাই পরিবহন করবো। কোনো দেশকে পরিবহন করতে হবে না।’

বেবিচক সূত্র জানায়, শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনাল চালুর আগে ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করায় বায়ারদের কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। কারণ, এখন শাহজালাল বিমানবন্দরে কার্গো চাপ বেড়েছে। করণীয় নির্ধারণ করতে সম্প্রতি অংশীজনদের নিয়ে বৈঠক করেছে বেবিচক চেয়ারম্যান। বৈঠকে শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের কার্গো এরিয়া দ্রুত সময়ে চালুর মত দেন অংশীজনেরা। তবে তৃতীয় টার্মিনালের সম্পূর্ণ কাজ শেষ না হওয়ায় (৯৯ শতাংশ কাজ শেষ) এখনই তা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। পরে প্রাথমিকভাবে সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দর ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে কার্গো ফ্লাইট পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়।

মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভারতে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছি। এখন নিজদের সক্ষমতা বাড়ানোর দারুণ সুযোগ পেয়েছি। নিজ ব্যবস্থাপনায় আমরাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কার্গো পণ্য পরিবহন করবো। এতে দেশের টাকা দেশেই থাকবে। উদ্যোক্তা এবং বায়ারদের সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে।’