ক্যাসিনো মামলার বিচারে দেরি, ‘রাঘববোয়ালরা’ ফিরছে বাড়ি
অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জালে আটকা পড়েন রাঘববোয়ালরা। গ্রেফতারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: ২০১৯ সালে বিভিন্ন খাতের অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ও অবৈধ অর্থের বিরুদ্ধে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ওই সময় সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল ঢাকার ক্লাবপাড়ায় আন্ডার ওয়ার্ল্ড ও আন্ডারগ্রাউন্ড নিয়ন্ত্রণাধীন ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান। ওই অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জালে আটকা পড়েন রাঘববোয়ালরা।
গ্রেফতারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট। তাকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে ক্লাবপাড়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। একে একে ধরা পড়ে ঢাকা নিয়ন্ত্রণকারী গডফাদাররা। ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে ৫৫টি মামলা হয়। এর মধ্যে ৩৫টি মামলায় চার্জশিট জমা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আলোচিত ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি নিয়ে এ পর্যন্ত একটি মাত্র মামলার রায় হয়েছে। অধিকাংশ মামলাই বিচারাধীন। এসব মামলার আসামিরা পর্যায়ক্রমে জামিন পেতে শুরু করেছেন। এসব মামলায় সম্রাটসহ চারজন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। অর্থপাচার মামলায় ক্যাসিনো কাণ্ডে আলোচিত বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক ভূঁইয়া ওরফে এনু, তার ভাই রুপন ভূঁইয়াকে সাত বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাদের চার কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।
এদিকে সম্রাট মুক্তি পাওয়ার পর সক্রিয় হয়ে উঠছে মতিঝিলের ক্লাবপাড়া। বেশ কিছু ক্লাবে সদস্য ও সদস্য ছাড়া যুবকদের আনাগোনা দেখা গেছে। তবে গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবটি ছিল বন্ধ অবস্থায়। সূত্র মতে, রাত হলেই ক্লাবগুলোর ভেতরে সদস্যরা সক্রিয় হয়ে উঠছে। তবে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ক্লাবগুলোতে এখন আর জুয়ার আসর বসানো হয় না। বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুধু আড্ডা চলে। এর আগে সম্রাটের তিন মামলার জামিন হওয়ার পর ক্লাবগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। বুধবার সর্বশেষ মামলায় সম্রাট মুক্তি পাওয়ায় নেতাকর্মী ও অনুসারীদের আনাগনা বেড়েছে ক্লাবগুলোতে।
বৃহস্পতিবার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের পরিচালক জামাল রানা বলেন, সম্রাট মুক্তি পাওয়ায় তিনি খুশি হয়েছেন। সম্রাটকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রয়োজন। মতিঝিল এলাকায় সম্রাট ছাড়া নেতৃত্বে কারও যোগ্যতা নেই। তিনি আরও বলেন, ওই সময়ে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে ক্যাসিনো কাণ্ডের ঘটনায় যে অভিযান পরিচালনা করা হয় সেটি ক্লাবের অন্যপাশের জায়গা। সেটি ছিল অডিটোরিয়াম। সেটি সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেওয়া ছিল। কিন্তু সেই অডিটোরিয়ামটি ব্যবহার করে কিছু লোক ক্যাসিনো খেলায় মেতে ওঠে। এ ঘটনায় গ্রেফতার লোকমান হোসেন ভূঁইয়া জানতেন না যে সেখানে ক্যাসিনো চালানো হয়। পরে জানার পর বন্ধ করার তাগিদ দেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করে। অবশ্য তিনি জামিনে মুক্তিও পেয়েছেন।
জামাল রানা আরও বলেন, ক্যাসিনোর অভিযানের পর ক্লাবের অডিটোরিয়ামটি এখনও বন্ধ রাখা হয়েছে। সেটি বন্ধ থাকলে ক্লাবের আয় কমবে। আমরা শিগগিরই সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য অডিটোরিয়ামটি খুলে দিতে সংশ্লিষ্টদের কাছে আবেদন করব। সরেজমিনে দেখা যায়, মতিঝিলে অবস্থিত ব্রাদার্স ইউনিয়ন লিমিটেড ক্লাবের সামনে কয়েকটি গাড়ি পার্কিং করা। ভেতরে ঢুকে কাউকে পাওয়া যায়নি। ক্লাবের পশ্চিম পাশে পরিচালক ইনচার্জ মহিউদ্দিন আহমেদ মহির কক্ষটি বন্ধ। প্রবেশদ্বারের উত্তর পাশে বসেন গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান এজেএম নাসির উদ্দিন। তার কক্ষেও তালা দেখা গেছে। পাশেই ক্রিকেট একাডেমি এবং ক্রিকেট কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. আমিন খানের কক্ষ। সেটিও বন্ধ পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে সেখানকার একজন স্টাফ বলেন, স্যাররা আসবেন সন্ধ্যার পর। তবে সরব দেখা গেছে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবকে। সেখানে বিভিন্ন লোকের আনোগোনা লক্ষ্য করা গেছ। ভেতরে কয়েকটি দামি গাড়িও দেখা গেছে। তবে কর্তৃপক্ষের কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
ক্যাসিনো মামলার সর্বশেষ পরিস্থিতি : তদন্তকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকায় ক্যাসিনোর ঘটনায় র্যাব, পুলিশ, সিআইডি ও দুদক মিলিয়ে তখন ৫৫টি মামলা করে। এর মধ্যে অস্ত্র, মাদক, মানি লন্ডারিং ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩২টি মামলা করে র্যাব, ডিবি ও সিআইডি। আর ১৩টি মামলা করেছে দুদক। মামলাগুলোর মধ্যে বিভিন্ন সংস্থা ৩৫টিতে আদালতে চার্জশিট দিয়েছে। এসব মামলায় সম্রাট ছাড়াও আরও তিনজন জামিন পেয়েছেন। তারা হলেন- ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হক মনজু, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ডিরেক্টর ইনচার্জ ও মোহামেডান ক্লাবের স্থায়ী সদস্য লোকমান হোসেন ভূঁইয়া এবং কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি ও কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ। প্রসঙ্গত, ক্যাসিনো মামলার আসামিরা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতা।
কেন বিচারে জট- এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আবু বলেন, ‘করোনার কারণে চার্জশিট দেওয়ায় দেরি হয়েছে। তাই বিচারকাজও দেরিতে শুরু হয়। তবে যেসব মামলায় চার্জশিট হয়েছে তার অধিকাংশেরই অভিযোগ গঠন করা হয়েছে, ট্রায়ালে আছে। আর মামলার বিচার অন্যান্য মামলার মতোই স্বাভাবিক গতিতে চলছে। এর জন্য আলাদা কোনো ট্রাইব্যুনাল হয়নি। এ ছাড়া সাক্ষীরা ঠিকমতো হাজির না হওয়ার কারণেও বিচার দেরি হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত বিচার শেষ করতে।’
দায়ের হওয়া মামলাগুলোর এজাহার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কয়েক হাজার কোটি টাকার অর্থপাচারের অভিযোগ রয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে। তারা ওই অর্থ ক্যাসিনো, মাদক, টেন্ডারবাজি ও অস্ত্রসহ নানা অবৈধ কাজের মধ্য দিয়ে আয় করে বড় একটি অংশ দেশের বাইরে পাচার করেন। তদন্তকারীরা বলছেন, করোনার কারণে তাদের মামলার তদন্তে দেরি হয়েছে। বাকি ২০টি মামলার তদন্তও শেষ পর্যায়ে আছে। অনেক মামলাই এখনও বিচারাধীন। তবে বিচার দ্রুত শেষ হওয়া না হওয়া আদালতের বিষয়।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:
https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews