কাজ না করেই লোপাট সাড়ে ৩ কোটি টাকা
বিদ্যালয়টি মেরামতের জন্য পিইডিপি-৪ এর আওতায় দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়ায় হয়েছে।
প্রথম নিউজ, রংপুর: রংপুর শহর থেকে একটু নিভৃতে মনোরম পরিবেশে দেওয়ান টুলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানোর জন্য একটি নতুন ভবন ও একটি পুরোনো ভবন আছে। নির্মাণের পর নতুন ভবনটি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করা হলেও সেখানে অদৃশ্য কারণে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানো হয় না। পুরনো ভবনেই চলছে পাঠদান।
এই বিদ্যালয়টি মেরামতের জন্য পিইডিপি-৪ এর আওতায় দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়ায় হয়েছে। নতুন ভবনের গ্রীল নির্মাণ, ভবনের ভেতর সজ্জিতকরণ দেখিয়ে সেই টাকা তোলাও হয়েছে। কিন্তু ১০ জুলাই পর্যন্ত বিদ্যালয় মেরামতের কোনো কাজ করা হয়নি। অথচ বিধি অনুযায়ী ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল।
জানতে চাইলে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা রাবেয়া খাতুন বলেন, অফিসিয়াল সিস্টেম অনুযায়ী আগে বিল ভাউচার জমা দিয়েছি। ইঞ্জিনিয়ারের দেওয়া ইস্টিমেট অনুযায়ী এই বিল ভাউচার তৈরি করি। বিল ভাউচার জমা না দিলে তো ট্রেজারি থেকে টাকা ছাড় দেয় না। কাজ করিনি, এখন করব। নগরীর প্রাণকেন্দ্রে গুপ্তপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়েও মেরামতের জন্য দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত বিদ্যালয়টিতে কোনো কাজ করা হয়নি। পুরোনো ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করলেও সেখানে ঝুঁকি নিয়ে চলছে পাঠদান। খসে পড়ছে পলেস্তরা।
বরাদ্দের টাকা কি করেছেন জানতে চাইলে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফরহাদ জাহান বলেন, বিল ভাউচার ও ইস্টিমেট জমা দিয়েছি। টাকা বা চেক কোনো কিছুই পাইনি। টাকা পেলে জুলাইয়ের মধ্যে কাজ শেষ করব। সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের উচ্চমান সহকারী (বড় বাবু) লিটন মিয়া বলেন, পিইডিপি-৪ এর ২য় পযার্য়ের ৭৬ লাখ টাকা শিক্ষা কর্মকর্তার ব্যাংক হিসাবে আছে। কাজ করলে প্রত্যয়ন দেখে শিক্ষকদের ওই টাকা দেওয়া হবে। সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম কার্যালয়ে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইলফোনে একাধিক কল ও ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও যোগাযাগ করা সম্ভব হয়নি।
রংপুর সদরের শুধু ওই দুই বিদ্যালয় নয় ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে পিইডিপি-৪ এর আওতায় রংপুরের ৮টি উপজেলার ১৮০টি বিদ্যালয়ের বিপরীতে ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা ২য় ধাপে বরাদ্দ দেওয়া হলেও প্রায় বিদ্যালয়ে কোনো কাজ হয়নি। অথচ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে দেখিয়ে ভুয়া ভাউচার জমা করে টাকা লোপাটের জন্য অভিনব কায়দায় বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। শিক্ষক ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসগুলোতে কথা বলে জানা গেছে, টাকা উত্তোলন করা না হলে তা সরকারি কোষাগারে ফেরত যেত। তাই বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করে শিক্ষা কর্মকর্তাদের ব্যাংক হিসাব নম্বরে রাখা হয়েছে।
গঙ্গাচড়া উপজেলার গঞ্জিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির রং উঠে ফেকাসে হয়ে গেছে। ভবনের দেয়ালের বিভিন্ন জায়গায় খসে পড়ছে পলেস্তরা, টিনে ধরেছে মরিচা। কিন্তু বিদ্যালয়টি মেরামতের দুই লাখ টাকা উত্তোলন হলেও সেখানে কোনো কাজ করা হয়নি। জানতে চাইলে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রওশন আরা বেগম বলেন, বিল, ভাউচার জমা দিয়েছি। টাকা এখনও পাইনি। কাজও করিনি। কাজ করব স্যারেরা দেখে টাকা দেবে।
গঙ্গাচড়ার চকচকে ঝকঝকে ধনতোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও সেখানে গিয়ে দেখা গেছে কোনো কাজ করা হয়নি। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রওশন আক্তার বলেন, স্কুলের নামে যে টাকা বরাদ্দ, তা এখনো পাইনি। কাজও করিনি। টাকা ম্যাডামের (শিক্ষা কর্মকর্তা) কাছে আছে। কাজ দুই একদিনের মধ্যে শুরু করব।
যোগাযোগ করা হলে গঙ্গাচড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাগমা সিলভিয়া মুঠোফোনে বলেন, কোনো কাজ করা হয়নি। টাকা তুলে অফিসিয়াল সিস্টেমে রাখা হয়েছে। আমি অসুস্থ ছুটিতে আছি। পরে কথা হবে। তারাগঞ্জের কোরানীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বরাদ্দের দুই লাখ টাকার কাজ ৩০ জুনের মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও ৮ জুলাই পর্যন্ত কোনো কাজ করা হয়নি। টাকা ঠিকই তোলা হয়েছে। জানতে চাইলে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহামুদা বেগম বলেন, আমি অসুস্থতায় ভুগছি। তাই কাজ শুরু করতে পারিনি। টাকা শিক্ষা অফিসে জমা আছে।
কাজ শেষ দেখিয়ে টাকা উত্তোলন ও শিক্ষা অফিসারের হিসাবে টাকা জমা রাখা অবৈধ কিনা জানতে চাইলে তারাগঞ্জের প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আঞ্জুমান আরা বেগম বলেন, ভাইচার না দিলে তো টাকা পাস হয় না। তাই বিল ভাউচার ও প্রত্যায়ন তৈরি করে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও বিষয়টি জানে। জানতে চাইলে পীরগাছা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আতিকুর রহমান বলেন, শেষ সময়ে বরাদ্দ আসায় টাকা উত্তোলন করে রাখা হয়েছে। সময় স্বল্পতার কারণে শিক্ষকেরা কাজ শুরু করতে পারেনি। বিদ্যালয় খুলেছে, কাজ করলে টাকা দেওয়া হবে।
এছাড়া ৮ জুলাই থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত রংপুর সদরের মাহিগঞ্জ বালক, মাহিগঞ্জ বালিকা, তাজহাট, আশরতপুর, গঙ্গচড়ার লালচাঁদপুর, শালবাড়ি, পূর্ব খলেয়া উপরতলা, তারাগঞ্জের শেরমস্ত, মধুরামপুর, তেতুলতলা, দোয়ালীপাড়া, মানব মঙ্গলসহ ১৫টি বিদ্যালয় সরেজমিনে ঘুরে একই চিত্র পাওয়া গেছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের প্রায় অভিন্ন কথা, কাজ করিনি, এখন করব। টাকা মেরে খাব না। এ বিষয়ে কথা হলে রংপুরের জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীন বলেন, কাজ না করে টাকা উত্তোলনের কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হবে।