‘ও বাবা গো’ বলেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আকাশ
তখন ঘড়ির কাঁটা সকাল সাড়ে ১১টা। হঠাৎ মুহুর্মুহু গুলি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুটি গুলি আকাশের শরীরে বিদ্ধ হয়।
প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক : ভাইয়া আমি নাস্তা খাবো। আচ্ছা আমি নিয়ে আসতেছি। এই কথা বলেই ছোট ভাইয়ের জন্য নাস্তা আনতে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় আরাফাত হোসেন আকাশ (১৬)। তখন ঘড়ির কাঁটা সকাল সাড়ে ১১টা। হঠাৎ মুহুর্মুহু গুলি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুটি গুলি আকাশের শরীরে বিদ্ধ হয়। ‘ও বাবা গো’ বলেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। এ দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারান বাবা আকরাম হোসেন। গুলির শব্দে প্রাণ বাঁচাতে মানুষের দিগ্বিদিক ছুটাছুটির মধ্যে কোনো ভাবে আকাশকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়ার পথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে। মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ২১শে জুলাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড় এলাকায় খানকা মসজিদের সামনে। নিহত আকাশের পারিবারিক তথ্যমতে, দুই ভাই এক বোনের মধ্যে আকাশ বড়।
এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল সে। টেস্ট পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ করায় শিক্ষকরা বলছিল ১০ হাজার টাকা হলে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দেয়া হবে। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে এত টাকা দেয়া সম্ভব হয়নি। তাই ক’মাস বাড়িতে ছিল। একদিন আকাশ তার মাকে বলে, মা যেহেতু টাকার জন্য লেখাপড়া হচ্ছে না তাহলে বাড়িতে বসে থেকে কি লাভ। বাবার কাছে চলে যাই। এরপর ৬ মাস আগে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের চিটাগাং রোড নয়াআটি মুক্তিনগর এলাকায় বাবা আকরাম হোসেনের কাছে চলে আসে আকাশ। তার বাবা ওই এলাকায় ফুটপাথে ফলের ব্যবসা করে। আকরাম হোসেন একটা গোডাউন ভাড়া নিয়ে সেখানে ফল রাখে এবং সেই গোডাউনেই ছেলেকে নিয়ে বসবাস করে। এক সপ্তাহ আগে আকরাম হোসেনের ছোট ছেলে আদনান (৬)কে ডাক্তার দেখানোর জন্য নিয়ে আসা হয় গ্রাম থেকে। ২১শে জুলাই সকালে আদনান আকাশকে বলে ভাইয়া আমি নাস্তা খাবো। তখন আকাশ বলে আচ্ছা আমি নিয়ে আসতেছি। এই কথা বলে সকাল সাড়ে ১১টায় বাসা থেকে সে বের হয়। খানকা মসজিদের সামনে পৌঁছাতেই গুলির শব্দ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, কিছু বুঝে ওঠার আগেই খানকা মসজিদের সামনে আকাশ গুলিবিদ্ধ হয়। ‘ও বাবা গো’ বলেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। তার বাম উরু ও মূত্রথলিতে দুইটা গুলি লাগে। দোকান থেকে দৌড়ে ছেলের কাছে এসেই জ্ঞান হারান আকরাম হোসেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মুহুর্মুহু গুলি, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এ সময় গুলির শব্দে প্রাণ বাঁচাতে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে লোকজন। অনেকেই সে সময় হতাহত হয়। কোনো মতে আকাশকে উদ্ধার করে স্বজনরা হাসপাতালের দিকে ছুটতে থাকে। কিন্তু পথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি থানার ওয়াসিতপুর এলাকায় পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। গ্রামের ওয়াসিতপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল আকাশ। নিহত আকাশের চাচাতো ভাই পাভেল জানায়, অত্যন্ত শান্ত ও ভদ্র একটা ছেলে ছিল আকাশ। গ্রামের সবাই তার মৃত্যুতে ব্যথিত হয়েছে। কারণ মুরুব্বিদের অনেক সম্মান করতো সে। কারও সঙ্গে কখনো ঝগড়া বিবাদ করেনি। এমন ভালো একটা ছেলের মৃত্যুতে আমরা শোকাহত।
এদিকে ছেলেকে হারিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আকরাম হোসেন ও তার স্ত্রী। কোনো ভাবেই তারা মেনে নিতে পারছেন না নিরপরাধ ছেলের এমন মৃত্যু।