এবার পীরগঞ্জে ২০ টি বাড়িতে আগুন
ফেনী ও নোয়াখালীতে নিরাপত্তা জোরদার
প্রথম নিউজ, ঢাকা: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক অবস্থান ও কঠোর নজরদারির মধ্যেই এবার রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ২০টি বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগে উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া এলাকায় রোববার রাত ১০টার দিকে এই ঘটনা ঘটে বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে।
রংপুর জেলা সহকারী পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান বলেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক যুবক ফেসবুকে ধর্ম নিয়ে অবমাননাকর পোস্ট দিয়েছেন—এমন গুজবে এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। উত্তেজিত কিছু লোক প্রায় ২০টি বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে।
এদিকে মন্দির-দোকানপাটে হামলার ঘটনার পর নোয়াখালী ও ফেনীতে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। মন্দিরগুলোতে পাহারা দিচ্ছে পুলিশ।
দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনের দোকানে হামলার প্রতিবাদে গত শনিবার জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের মানববন্ধন চলাকালে ঢিল ছোড়াকে কেন্দ্র করে ফেনীতে সংঘর্ষ হয়। পরে সেখানে একটি মন্দির ও একটি আশ্রমে এবং বেশ কিছু দোকানে হামলার ঘটনা ঘটে। এর আগে গত শুক্রবার নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীতে মন্দির ও দোকানপাটে হামলা-ভাঙচুর চালানো হয়। ওই ঘটনায় মারা গেছেন দুজন।
গতকাল ফেনী শহরের ট্রাংক রোড ও তাকিয়া রোডের মোড়ে শ্রীশ্রী কালীমন্দিরের সামনে পুলিশের পাহারা দেখা যায়। ফেনীর বড় বাজারের কালীমন্দির, জগন্নাথবাড়ি মন্দির, বাঁশপাড়া মন্দিরসহ শহরের সব মন্দিরের সামনেই পুলিশের পাহারা দেখা গেছে।
গত শনিবার হামলা হয়েছিল শহরতলির কালীপাল গাজীগঞ্জ মহাপ্রভুর আশ্রম ও দুর্গামন্দিরে।
গতকাল সেখানে গিয়ে দেখা যায়, একটি গাড়ির ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। মন্দিরের বাইরের সিসি ক্যামেরাগুলো ভাঙা। সেখানে দুটি জানালা আংশিক ও প্লাস্টিকের কিছু চেয়ার ভাঙচুর করা হয়।
শহরের তাকিয়া রোডে একসঙ্গে ছয়টি দোকানের শাটার ভাঙা দেখা যায়। চন্দন রাইসের মালিক চন্দ্রনাথ সাহা অভিযোগ করেন, তাঁর দোকানের শাটার ভেঙে বেশ কিছু মালামাল বাইরে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। তাঁর দোকানের ক্যাশ বাক্সে থাকা প্রায় দুই লাখ টাকা লুট করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। একই সড়কে ১০টি শুঁটকির দোকানের শাটারও ভাঙা দেখা গেছে।
গতকাল সকালে ফেনীর জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ উল হাসান, পুলিশ সুপার খোন্দকার নুরুন্নবী ফেনীর বিভিন্ন মন্দির পরিদর্শন করেন। র্যাব-৭ চট্টগ্রামের অধিনায়ক লে. কর্নেল এ এস এম ইউছুফও মন্দির পরিদর্শন করেন।
দুটি মন্দির ও বেশ কয়েকটি দোকানপাটে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় মডেল থানায় দুটি মামলা হয়েছে। ফেনী মডেল থানার দুজন উপপরিদর্শক (এসআই) বাদী হয়ে মামলা দুটি করেন। একটি মামলায় ২০০ থেকে ২৫০ জন এবং অপর একটি মামলায় ১০০ থেকে ১৫০ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। তবে গতকাল বিকেল পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
ফেনীতে শনিবারের সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজনকে আটক করেছে র্যাব। গতকাল সদর থানা এলাকা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা হলেন আহনাফ তৌসিফ মাহবুব লাবিব, আবদুস সালাম জুনায়েদ ও ফয়সাল আহমেদ আল আমিন।
গতকাল সকালে চৌমুহনীর ব্যাংক রোডের রাধামাধব জিওর মন্দির ও রামঠাকুরের আশ্রম ঘুরে দেখা যায়, পুলিশ ও আনসারের সদস্যরা সতর্ক পাহারায় রয়েছেন। এ ছাড়া অন্যান্য মন্দিরের সামনে এবং শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশ ও আনসার সদস্য মোতায়েন আছে। বিজিবি ও র্যাবের সদস্যরাও টহলে আছেন।
গতকাল দেখা যায়, দুই দিন আগে হামলা-ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত দোকানগুলো এখনো বন্ধ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাম ঠাকুরের আশ্রম এলাকার একজন ব্যবসায়ী বলেন, অনেকে এখনো আতঙ্কিত, তাই দোকান খুলছেন না।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামছুন নাহার বলেন, চৌমুহনীর সার্বিক পরিস্থিতি এখন শান্ত। মন্দিরের সামনে ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
ডিসি-এসপির অপসারণ দাবি
চৌমুহনীতে মন্দির, দোকানপাটে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় ‘ব্যর্থতার দায়’ স্বীকার করে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারের (এসপি) অনতিবিলম্বে অপসারণ দাবি করেছেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।
গতকাল দুপুরে চৌমুহনীতে হামলা-ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি মন্দির পরিদর্শন শেষে এ দাবি জানান তিনি।
রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘নোয়াখালীর ঘটনার ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে নোয়াখালীর ডিসি ও এসপির অনতিবিলম্বে অপসারণ দাবি করছি। সেই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে চিহ্নিত করে অনতিবিলম্বে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
পরে সন্ধ্যায় রানা দাশগুপ্ত ফেনীতে হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে শহরের ট্রাঙ্ক রোডের শ্রীশ্রী কালীমন্দির চত্বরে তিনি বক্তব্য দেন।
এ সময় আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দত্ত, সাধারণ সম্পাদক নির্মল চ্যাটার্জি, সহসভাপতি প্রিয়রঞ্জন দত্ত। সভাপতিত্ব করেন ফেনী জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সহসভাপতি হিরা লাল চক্রবর্তী।
চট্টগ্রাম নগরের জে এম সেন হলের পূজামণ্ডপসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। এর আগে নগরের প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়। বিকেলে অনুষ্ঠিত কর্মসূচির মূল আয়োজক আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটি।
চট্টগ্রাম ইসকন বিভাগীয় সম্পাদক শ্রীপাদ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ পালিত, শ্রীশ্রী জন্মাষ্টমী উদ্যাপন পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক চন্দন তালুকদার।
সমাবেশ শেষে মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ ছিল। আন্দরকিল্লায় মিছিলের অগ্রভাগ পৌঁছে যাওয়ার পরও জামালখান মোড়ে তখনো মিছিলের শেষের অংশ ছিল।
মঠ-মন্দিরে হামলার ঘটনার বিচারের দাবিতে আজ সোমবার থেকে চার দিনের প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের চট্টগ্রাম মহানগর শাখা। এর মধ্যে আজ বিকেল চারটায় মানববন্ধন, মঙ্গলবার প্রতীক অনশন, বুধবার বিকেলে সমাবেশ ও বৃহস্পতিবার মোমবাতি প্রজ্বালনের কর্মসূচি রয়েছে।
গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন পরিষদের সভাপতি আশীষ ভট্টাচার্য। উপস্থিত ছিলেন সাধারণ সম্পাদক হিল্লোল সেন।