এবি ব্যাংক গ্রাহকের সোয়া ২ কোটি টাকা ক্যাশ কর্মকর্তার পকেটে

এবি ব্যাংক গ্রাহকের সোয়া ২ কোটি টাকা ক্যাশ কর্মকর্তার পকেটে

প্রথম নিউজ, সিলেট: গ্রাহকের দুই কোটি ১২ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে এবি ব্যাংক সিলেটের ওসমানীনগরের তাজপুর শাখার ক্যাশ অফিসারের বিরুদ্ধে। আত্মসাৎ করা টাকা ১২ জন প্রবাসীর। ঘটনার মূল হোতা ওই শাখার সিনিয়র ক্যাশ অফিসার অ্যান্ড হেড টেলার মো. ইস্তাকুর রহমান। গ্রেফতার হলেও বর্তমানে তিনি জামিনে। তাকে সহযোগিতার দায়ে ব্যাংকটির আরও ছয় কর্মকর্তা বর্তমানে কারাগারে।

জানা যায়, চলতি বছরের ৯ মে এবি ব্যাংকের তাজপুর শাখার ক্যাশ কর্মকর্তা ইস্তাকুরের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ পায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ঘটনার পরদিন ১০ মে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন এবি ব্যাংকের অ্যাসিসট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও তাজপুর শাখার ব্যবস্থাপক ইয়াকুতুল গণি। পরদিন পুলিশ ইস্তাকুর রহমানকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়।

ঘটনার ছয় মাস পর গত ২০ নভেম্বর ইস্তাকুর জামিনে মুক্তি পান। এর পরদিন ব্যাংকের আরও ছয় কর্মকর্তাকে ওই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। অর্থ আত্মসাৎকারী ইস্তাকুর রহমানকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করার দায়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওসমানীনগর থানার উপ-পরিদর্শক মো. নুর হোসেন। গত ২১ নভেম্বর ব্যাংকের ছয় কর্মকর্তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। পলাতক আছেন একজন।

এবি ব্যাংকে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ মামলায় এখন পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একজন উচ্চ আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন। বাকি ছয়জন কারাগারে। গ্রেফতাররা সবাই এবি ব্যাংকের তাজপুর শাখার কর্মকর্তা।-ওসমানীনগর থানার ওসি রাশেদুল হক

মামলা সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ৯ মে সালমা বেগম নামে এক নারীর অ্যাকাউন্ট থেকে জাল স্বাক্ষরে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা তোলেন ইস্তাকুর রহমান। ঘটনাটি সন্দেহজনক মনে হলে তাজপুর শাখা ব্যবস্থাপক ইয়াকুতুল গণিকে অবগত করেন ব্যাংকের অন্য কর্মকর্তারা। এরপর জানাজানি হয় ইস্তাকুর রহমানের অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি। তবে ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ ছিল।

১০ মে ব্যাংকের অন্য নথিপত্র ও বেশ কয়েকটি অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্ট খুঁজে আরও অর্থ লুটের তথ্য বেরিয়ে আসে। নতুন চেকবই ইস্যু করে ও স্বাক্ষর জাল করে ছয়টি অ্যাকাউন্ট থেকে ৩৮ লাখ ৭০ হাজার ৯০০ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। পরে ব্যাংকের অডিটে আরও ছয়টি অ্যাকাউন্ট থেকে একই কায়দায় ১ কোটি ৭৩ লাখ ৮১ হাজার টাকাসহ মোট দুই কোটি ১২ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা আত্মসাতের সত্যতা মেলে।

যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে সেগুলো ডরমেন্ট অ্যাকাউন্ট (ব্যাংকের কোনো হিসাব যদি গ্রাহক দীর্ঘদিন লেনদেনহীন অবস্থায় রাখেন তখন সেটি ডরমেন্ট অ্যাকাউন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়)। ডরমেন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে চাইলেই লেনদেন করা যায় না। বেশ কিছু নিয়ম মানতে হয়।

সূত্র জানায়, ঘটনার পর তাজপুর শাখা থেকে ব্যাংকের সব কর্মকর্তাকে ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত করে নেওয়া হয়। তদন্ত শেষে প্রথম দিকে ইস্তাকুর ছাড়া আর কোনো কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তবে ঘটনার ছয় মাস পর গত ২১ নভেম্বর সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় ব্যাংকের আরও ছয় কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়।

মামলার এজাহারে যা বলা হয়েছে: সিলেটের ওসমানীনগর থানায় দায়ের করা এজাহারে এবি ব্যাংকের অ্যাসিসট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও তাজপুর শাখার ব্যবস্থাপক ইয়াকুতুল গণি ওসমানী উল্লেখ করেন, ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর মো. ইস্তাকুর রহমান এবি ব্যাংকের তাজপুর শাখায় সিনিয়র ক্যাশ অফিসার অ্যান্ড হেড টেলার (আইডি ৪৬৪১৫) হিসেবে যোগ দেন। চলতি বছরের ৯ মে সালমা বেগম নামে এক নারীর অ্যাকাউন্ট থেকে জাল স্বাক্ষরে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা তুলে নেন ইস্তাকুর। অন্য স্টাফদের সন্দেহ হলে পরদিন ১০ মে বিষয়টি তাকে অবগত করেন। ওইদিন বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে দেখা যায় একই তারিখে সালমা বেগম ছাড়াও মো. আনোয়ার আলী নামে এক ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট থেকে নগদ ৫ লাখ টাকা, মিসেস আনোয়ারা খাতুন নামে এক নারীর অ্যাকাউন্ট থেকে দুই দফায় ১০ লাখ টাকা উত্তোলন করেন।

এছাড়া চলতি বছরের এপ্রিল মাসে জুবায়ের আহমদ নামে এক ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট থেকে দুই দফায় ৮ লাখ ২৯ হাজার টাকা, মো. জুয়েল আহমেদ নামে এক ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট থেকে দুই দফায় চারটি চেকের মাধ্যমে ৯ লাখ ২১ হাজার ৯০০ টাকা, মিসেস উরফুল নেছা অ্যান্ড মিস্টার ময়ূর নামে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে তিনটি চেকের মাধ্যমে ৮ লাখ ৫০ হাজার টাকাসহ সর্বমোট ৩৮ লাখ ৭০ হাজার ৯০০ টাকা উত্তোলন করেন ইস্তাকুর।

এজাহারে ইয়াকুতুল গণি ওসমানী আরও উল্লেখ করেন, তিনি ও অফিসের অন্য স্টাফদের জিজ্ঞাসাবাদে ইস্তাকুর অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি স্বীকার করেন। পরবর্তীসময়ে আত্মসাৎ করা টাকার মধ্যে ১২ লাখ ৭০ হাজার টাকা চলতি বছরের ৫ মে ব্যাংকের ডিএডিতে (ডিপোজিট অ্যাওয়েটিং ফর ডিসপোজাল) জমা করেন। অবশিষ্ট ২৬ লাখ ৯০০ টাকা ইস্তাকুর রহমানের কাছে রয়েছে। অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে ব্যাংকের আঞ্চলিক প্রধানসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে লিখিতভাবে স্বীকারোক্তি ও জবানবন্দি দিয়েছেন ইস্তাকুর।

এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি এবি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অবগত করলে দুই সদস্যের একটি টিম চলতি বছরের ১১ মে ব্যাংকের তাজপুর শাখায় তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেন। প্রাথমিক তদন্তে ইস্তাকুরের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পায় কমিটি।

ইস্তাকুরের বিরুদ্ধে ৩৮ লাখ ৭০ হাজার ৯০০ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাতের অভিযোগ থাকলেও ব্যাংকের অডিটে আরও ছয়টি অ্যাকাউন্ট থেকে একই কায়দায় ১ কোটি ৭৩ লাখ ৮১ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয় বলে মামলার নথিতে উল্লেখ করা হয়। আত্মসাৎ করা এ টাকার মধ্যে আজিজুর রহমানের অ্যাকাউন্ট থেকে ১৭ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ টাকা, হাওয়ারুন নেছার অ্যাকাউন্ট থেকে ১ লাখ ৮৭ হাজার, রাশিদা খাতুনের অ্যাকাউন্ট থেকে ১০ লাখ ৭৯ হাজার, কানু বিবি ও আব্দুস সালামের অ্যাকাউন্ট থেকে ৪০ লাখ ৯৪ হাজার, মো. আছকির আলীর অ্যাকাউন্ট থেকে ৭ লাখ ৭৬ হাজার ও আলা মিয়া নামে এক ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট থেকে ১৮ লাখ ১০ হাজার ৯০০ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন ইস্তাকুর। এছাড়া ব্যাংকের রিজার্ভ ক্যাশ থেকে ৬৬ লাখ ও এটিএম বুথ থেকে আরও ২ লাখ টাকা তোলেন তিনি।

যে কারণে ব্যাংকের আরও ছয় কর্মকর্তা কারাগারে: ঘটনার দুদিন পর ১২ মে এবি ব্যাংকের তাজপুর শাখার ব্যবস্থাপকের দায়ের করা মামলায় ইস্তাকুর রহমানকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। এরপর ব্যাংকের সব কর্মকর্তাকে ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

একটি সূত্র জানায়, ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ঢাকায় সংযুক্ত করে বিভিন্ন ধাপে তাদের কার্যক্রম খতিয়ে দেখা হয়। এসময় ইস্তাকুর ছাড়া অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে আর কারও জড়িত থাকার প্রমাণ পায়নি। ফলে ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগ তাদের কাজে যোগ দেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখায়।

 অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় প্রথমে ইস্তাকুরের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। পরে ব্যাংকের অডিটে মোট ২ কোটি ১২ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া যায়। এ অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে আরও কয়েকজনের সংশ্লিষ্টতা থাকায় অডিট রিপোর্ট আমরা পুলিশকে দিয়েছি। পুলিশ সে মোতাবেক ব্যবস্থা নিয়েছে।- এবি ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সিলেটের আঞ্চলিক প্রধান মো. অলিউর রহমান

 মামলার নথি ঘেঁটে দেখা যায়, গত ৯ নভেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওসমানীনগর থানার উপ-পরিদর্শক মো. নুর হোসেন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দেওয়া হয় এবি ব্যাংকের তাজপুর শাখার ব্যবস্থাপককে। চিঠিতে ব্যাংকের ওই শাখার সাবেক কর্মকর্তা মো. সাদিকুর রহমান, আব্দুল হাকিম সুহিন, মো. ইলিয়াছ মাছুম, ইয়াছিন খন্দকার প্রিয়ম, হীরক পুরকায়স্ত, মো. ফরিদ উদ্দিন ও মো. চইল হোসেনকে ২১ নভেম্বর সকাল ১০টায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে হাজির হতে বলা হয়। ইয়াছিন খন্দকার প্রিয়ম ছাড়া বাকি ছয় কর্মকর্তা থানায় এলে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তাদেরও গ্রেফতার দেখানো হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. নুর হোসেন  বলেন, ‘অর্থ আত্মসাতের মূল হোতা ইস্তাকুর রহমানকে বিভিন্ন চেক ইস্যু, বন্ধ অ্যাকাউন্ট চালু, রিকুইজিশন স্লিপ ও নতুন চেক বিতরণে সহযোগিতা করায় এবং ব্যাংকের অডিট টিমের তদন্তে বিষয়টির সত্যতা পাওয়ায় তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। ২১ নভেম্বরই তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। এছাড়া জড়িত আরেকজন কর্মকর্তা পলাতক।’

ওসমানীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাশেদুল হক বলেন, ‘এবি ব্যাংকে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ মামলায় এখন পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একজন উচ্চ আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন। বাকি ছয়জন কারাগারে। গ্রেফতাররা সবাই এবি ব্যাংকের তাজপুর শাখার কর্মকর্তা।’

এ বিষয়ে এবি ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সিলেটের আঞ্চলিক প্রধান মো. অলিউর রহমান বলেন, ‘অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় প্রথমে ইস্তাকুরের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। পরে ব্যাংকের অডিটে মোট ২ কোটি ১২ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া যায়। এ অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে আরও কয়েকজনের সংশ্লিষ্টতা থাকায় অডিট রিপোর্ট আমরা পুলিশকে দিয়েছি। পুলিশ সে মোতাবেক ব্যবস্থা নিয়েছে।’