উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে সঞ্চয়পত্র ভাঙার হিড়িক
দেশের বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকার পরও সবধরনের নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: দেশের বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকার পরও সবধরনের নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন। কোনোভাবেই দ্রব্যমূল্যের উত্তাপ কমছে না। চাল, ডাল, চিনি, আটা-ময়দা, শাক-সবজি, মাছ-মাংস, ডিম, পিয়াজসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের দামই বেড়েছে। অনেক পণ্যের সেঞ্চুরি পার করেছে। এগুলো কিনতেই স্বল্পআয়ের মানুষের আয়ের সিংহভাগ চলে যায়। জীবনযাত্রার ব্যয়ের বিপরীতে মানুষের আয় সেইভাবে বাড়ছে না।
যে কারণে উচ্চমূল্যস্ফীতির চাপে নিম্ন আয়ের মানুষ বেশ কষ্টে আছে। বাড়তি ব্যয়ের চাপ সামলাতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে এখন ঋণ করতে হচ্ছে অথবা আগের জমানো সঞ্চয়ে হাত দিতে হচ্ছে। পুরনো সঞ্চয়পত্র ভেঙে খেতে হচ্ছে। আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্যের কারণে এই প্রবণতা এখন আর অল্প সংখ্যকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বিশাল একটা পরিসরের মাঝে সঞ্চয়পত্র ভাঙার হিড়িক পড়েছে।
ফলে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণও কমে গেছে। এছাড়া সঞ্চয়পত্রে সুদহার অপরিবর্তিত রাখার বিপরীতে ব্যাংকের আমানত ও বিল বন্ডের বিনিয়োগে সুদহার বেড়ে যাওয়া, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে কড়াকড়ি আরোপসহ নানা কারণে মানুষ এখন নতুন করে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে না। উল্টো অব্যাহতভাবে সঞ্চয়পত্র ভাঙার প্রবণতা বাড়ায় গত অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) নিট বিক্রির পরিমাণ ঋণাত্মক হয়ে গেছে।
এদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গত জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু মূল্যস্ফীতির হার না কমে উল্টো আরও বেড়ে ১০ শতাংশের কাছাকাছি উঠেছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, মূল্যস্ফীতি এখন কেবল সাধারণ মানুষের কাছেই নয়; পুরো অর্থনীতির জন্য হয়ে উঠেছে বড় আতঙ্কের। প্রায় দুই বছর ধরে চলা এই সূচকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা, নতুন করে গরিব বানিয়েছে বড় একটা জনগোষ্ঠীকে। অন্যদিকে, খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতেও, নিত্য-নতুন উপায় খুঁজেছেন অনেকে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা গেছে, মে মাসে নিট বিক্রি ঋণাত্মক হয়েছে ৩ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে নিট বিক্রি ঋণাত্মকের পরিমাণ ১৭ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়েও নিট বিক্রি ঋণাত্মক ধারায় ছিল। তবে ওই সময় এর পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরের একই সময়ে সঞ্চয়পত্রে নিট বিক্রি কমেছে ৩৮৬ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। যদিও অর্থবছর শেষে নিট বিক্রি হয়েছিল ঋণাত্মক প্রায় ৩ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ পুরো অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকার এক টাকারও ঋণ নেয়নি। বিষয়টিকে মাথায় রেখে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা আরও কমানো হয়েছে।
আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্র থেকে ভাঙানো বাবদ (নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে বা মেয়াদান্তের আগে) আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে নিট বিক্রি বলা হয়। নিট বিক্রিকে সরকারের ধার বা ঋণ হিসেবে গণ্য করা হয়। একজন গ্রাহক আক্ষেপের সুরে বলেন, দ্রব্যমূল্যের তীব্র কষাঘাতে মানুষ জর্জরিত। যেখানে সঞ্চয়পত্রে ইন্টারেস্ট রেট বাড়ার কথা সেখানে সরকার সর্বস্তরে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমিয়ে ইন্টারেস্ট কমিয়ে দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, কড়াকড়ি আরোপ করার পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ খুব বেশি মুনাফা পাচ্ছে না। ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। এ ছাড়া ঋণের বোঝা কমাতে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়া কমিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে টিআইএন এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলক করায় অনেকেই সঞ্চয়পত্রে আগের মতো বিনিয়োগ করতে পারছেন না। আগে কালো টাকাও সঞ্চয়পত্র খাতে বিনিয়োগ হতো। এখন সেটা হচ্ছে না।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, মানুষের হাতে এখন টাকা কম। বর্তমান মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ আর আগের মতো সঞ্চয় করতে পারছে না। আর সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার কম ঋণ নিয়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে অনেক বেশি ঋণ নিচ্ছে। ফলে সঞ্চয়পত্র কম বিক্রি হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, মূল্যস্ফীতি একধরনের কর; ধনী-গরিব-নির্বিশেষে সবার ওপর চাপ সৃষ্টি করে মূল্যস্ফীতি। আয় বৃদ্ধির তুলনায় মূল্যস্ফীতির হার বেশি হলে গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষ সংসার চালাতে ভোগান্তিতে পড়েন। দুই বছর ধরে চলা এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। প্রভাব পড়ছে মানুষের যাপিত জীবনে।
সমপ্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, গত জুন মাসে দেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯.৭২ শতাংশ। এর আগে মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৮৯ শতাংশ। জুন মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০.৪২ শতাংশ। বাস্তবে এর হার আরও অনেক বেশি। তাই সঞ্চয়পত্র থেকে পাওয়া লাভ দিয়ে খরচই মিটছে না মানুষের। এর প্রভাব পড়েছে সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগে। দেখা যাচ্ছে, মানুষ বিনিয়োগ তো করছেই না, বরং সঞ্চয়পত্র ভেঙে খাচ্ছে।
সবজির বাজারে উত্তাপ: তথ্য-উপাত্ত বলছে, জিনিসপত্রের উচ্চ দামের কারণে মধ্যবিত্তের প্রায় নাভিশ্বাস অবস্থা। আয় না বাড়লেও বাজার থেকে বেশি দাম দিয়ে সব ধরনের নিত্যপণ্য কিনতে হচ্ছে তাদের। এছাড়া সামপ্রতিক সময়ে খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পণ্যের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। যার ফলে বাজারে সরবরাহ কিছুটা কমে গেছে। এটি দাম বাড়ার কারণ হতে পারে।
একমাসের বেশি অস্থিরতা বিরাজ করছে পিয়াজের বাজারে। দফায় দফায় পণ্যটির দাম বেড়ে এখন খুচরা বাজারে ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পিয়াজের পর বাজারে আলুর দামও বাড়ছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে পণ্যটির দাম বেড়েছে কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা। খুচরায় প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা দরে, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৬০ টাকার আশপাশে। এদিকে ডিমের হালি বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। বাজারে পেঁপে বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫০-৬০ টাকায়। একইভাবে লতি ৫০-৬০ টাকা থেকে বেড়ে ৭০-৮০ টাকায়, করলা ৬০-৮০ টাকা থেকে বেড়ে ১০০-১২০ টাকায় ও বরবটি ৬০-৭০ টাকা থেকে বেড়ে ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাঁচামরিচের দাম মাঝে কেজিপ্রতি ১৬০-১৮০ টাকা হয়েছিল, এখন তা আবার বেড়ে ২০০-২৪০ টাকা হয়েছে। পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকার পরও এক সপ্তাহের ব্যবধানে সবধরনের চালের দাম বস্তাপ্রতি বেড়েছে। ইতিমধ্যে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) চালের দাম বেড়ে গেছে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত; যা কেজি প্রতি দাঁড়ায় ২ থেকে ৬ টাকা। এর প্রভাবে এরইমধ্যে বাজার চড়া হতে শুরু করেছে বলে দাবি বিক্রেতাদের। রাজধানীর বাজারগুলোতে সাতদিন আগেও এক কেজি মোটা পাইজাম চাল বিক্রি হয়েছে ৪৮ টাকায়। কিন্তু এখন ওই চালই বিক্রি হচ্ছে ৫৩-৫৪ টাকায়। যে মিনিকেট চাল বিক্রি হয় ৬৮-৭০ টাকায়, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৭২-৭৫ টাকায়। কেজিতে ৮-১০ টাকা বেড়েছে নাজিরশাইলের দাম। বর্তমানে প্রতিকেজি নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়।
মুজাহিদ নামে এক ক্রেতা বলেন, চলতি বছর ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। অথচ চালের দাম কমেনি বরং বেড়েছে। বাজারে গেলে নিত্যপণ্যের দাম দেখে চমকে যাই। প্রতিদিন জিনিসপত্রের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এর শেষ কোথায়?