Ad0111

‘ইউ আর লেট রূশদ! হোয়াট ইউ ওয়্যার টট এট মিলিটারি একাডেমি?’

‘ইউ আর লেট রূশদ! হোয়াট ইউ ওয়্যার টট এট মিলিটারি একাডেমি?’
প্রথম নিউজ, ঢাকা: ‘ইউ আর লেট রূশদ! হোয়াট ইউ ওয়্যার টট এট মিলিটারি একাডেমি?’- জেনারেল মীর শওকত আলী,বীর উত্তম। ২০০০ সাল। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষানীতির উপর সিরিজ সাক্ষাতকার ভিত্তিক প্রতিবেদন তৈরি করছি। প্রথিতযশা সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তা, বুদ্ধিজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীসহ অনেকের ইন্টারভিউ নিচ্ছি ধারাবাহিকভাবে। সামরিক কর্তাদের কাছ থেকে সাক্ষাতকার নেয়া খুবই ঝক্কির ব্যাপার।তাঁরা খুব খুতখুতে, এ্যাপয়েন্টমেন্ট জোগাড় করতে হয়, সাক্ষাতকার নেয়া হয়, লিখতে হয়, তাদের দেখিয়ে আনতে হয়-এমন আরো কতো কি? যদিও একবার সাক্ষাতকার নেয়ার পর কাউকে তা দেখানোর রেওয়াজ নেই। কিন্তু ওই যে, কিছুদিন সেনাবাহিনীতে ছিলাম! সিনিয়ররা সঙ্গতকারনেই তাদের মতামত ঠিক ভাবে যাচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত হতে চান।চরম কষ্টসাধ্য ব্যাপার বৈকি। আমি হাসিমুখে সেই কষ্ট সহ্য করি। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষানীতির উপর সাক্ষাতকার নেয়া হবে আর লে.জেনারেল মীর শওকত আলী বাদ পড়বেন তা কি হয়? তিনি মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি, বীর উত্তম, রণাঙ্গনের সেক্টর কমান্ডার। এছাড়া তাঁর সেই ‘ভয়াবহ’ মোচটার ভীতি তো আছেই!
জেনারেল শওকতের সাথে আমার বয়সের ব্যবধান দুস্তর। তার উপর সেই আমলের লে.জেনারেল। যদিও তাঁর সাথে কয়েকবার দেখা হয়েছে, তারপরও কথা থাকে। ভয়ে ভয়ে তাঁর বাসার নম্বরে ফোন করলাম। সালাম দেয়ার পর ইংরেজিতে জানতে চাইলেন হাউ আর ইউ রূশদ? ফোন করার কারন জেনে তৎক্ষনাত বললেন কাল বিকাল ঠিক পাঁচটায় চলে এসো আমার বাসায়। পরদিন সকাল থেকে আমার হার্টবিট বেড়ে গেল।ইতোমধ্যে কয়েকজন জেনারেলের ইন্টারভিউ জোগাড় করেছি, কিন্তু জেনারেল মীর শওকত আলাদা ব্যক্তিত্ব। তাঁর সম্পর্কে যা শুনেছি তাতে আমার সতর্ক হওয়াটাই স্বাভাবিক। তিনি হিউমারাস, জোক বলতে পছন্দ করেন, নির্ভয়, গোলাগুলির সামনে দাড়িয়ে নির্বিকার থাকেন, জুনিয়রদের রেসপনসিবিলিটি কাঁধে নেন, কিন্তু কাজের সময় রীতিমতো বাঘ,পুরোদস্তুর পেশাদার। ঢাকার সড়কে তখন খুব একটা যানজট ছিল না। তারপরও কেন জানি কিছুটা দেরী হয়ে গেল। জেনারেল শওকতের গুলশানের বাসার কলিংবেল যখন টিপলাম তখন পাঁচটা বেজে চার মিনিট! দোয়া দরুদ পড়ছি, উদ্বিগ্ন বোধ করছি। দরজা খুললেন স্বয়ং জেনারেল শওকত। আমি সালাম দিলাম। তিনি বা হাতের কনুই উঁচু করে ঘড়ির দিকে তাকালেন। ইউ আর লেট রূশদ! হোয়াট ইউ ওয়্যার টট এট মিলিটারি একাডেমি? হু ওয়াজ ইউর কমান্ডান্ট?
মনে হলো দৌড়ে পালাই। না,তিনি উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। সাদরে বললেন, ভিতরে আসো। ঠিক লেজ নামানো বিড়ালের মতো ঘড়ে প্রবেশ করলাম। ঢুকতেই তাঁর পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট থাকাবস্থার সাদা কালো ছবি, সামরিক পোশাকের আরো কয়েকটা ছবি পাশাপাশি টাঙ্গানো। তিনি বেশ হালকা গলায় বললেন, লেটস গো টু দি স্টাডি রুম। বুঝেছো, আজ তোমার ভাবী বাসায় নেই। কেউ নেই। স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করছি। চলো দু’জনে আড্ডা মারি! দি ইস রিয়েল ইন্ডিপেন্ডেন্স! মুহূর্তেই পরিবেশটা সহজ হয়ে গেল। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে পড়লো আমার একজন কমান্ডিং অফিসারের জেনারেল শওকতকে নিয়ে বলা একটি মজার ঘটনার কথা। নবম পদাতিক ডিভিশন কেবল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী সেটার জিওসি। আমার সিও সেসময় কেবল লেফটেন্যান্ট, ব্যাচলর।একদিন তাঁরা কয়েকজন ব্যাচেলর অফিসার অফিসার্স মেসে লুকিয়ে সংগ্রহ করা প্লেবয় ম্যাগাজিন ততোধিক লুকিয়ে পড়ছেন। পড়ছেন মানে সুন্দরী আওরতদের ছবি দেখছেন মনযোগ দিয়ে। আশপাশে খেয়াল নেই। হঠাৎ তাদের সোফার পিছন থেকে রাশভারী কন্ঠে শোনা গেল- ইয়াং মেন, হোয়াট দ্যা হেল আর ইউ লুকিং এ্যাট? প্লেবয়? মাই গড! ডোন্ট রিড ইট হেয়ার! তারপর ম্যাগাজিনটি বগলদাবা করে চলে গেলেন জিওসি! ব্যাচেলর অফিসাররা পালিয়ে বাঁচলেন।ভয়ে তাঁদের অবস্থা কাহিল। বাট,নো এ্যাকশন টেকেন! আমাকে নিয়ে জে.শওকত তাঁর স্টাডি রুমে ঢুকলেন। একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন। রুমে পড়ার একটা টেবিল, তাতে ডেস্কটপ কম্পিউটার, সোফা, একটা সিঙ্গেল খাট। কেবল বসেছি। ওমা! স্যার দেখি কার্পেটের উপর শুয়ে খাটের নীচ থেকে কি যেন টেনে বেড় করার চেষ্টা করছেন। আমি তটস্থ হয়ে বললাম, স্যার কি বের করতে হবে? আমি বের করে দিচ্ছি।
না, তুমি বসো। এটা অতি গোপনীয় জিনিস। বহু কষ্টে অতি গোপনীয় জিনিসটি বের করলেন জেনারেল শওকত আলী। একটা পুরনো এ্যাটাচি কেস। খাটের উপর রেখে তা খুললেন। আমি পাশে দাড়ানো। দেখি ওতে কিছু টাকা বিক্ষিপ্তভাবে রাখা। আর বেশক’টি পুরনো কাগজপত্র। কয়েকটি পাচশ টাকার নোট পকেটে গুজে তিনি সেই ‘অতি গোপনীয় জিনিসটিকে’ আবার খাটের নীচে চালান করে দিলেন। আমার অবাক করা ভাব দেখে বেশ খুশির সাথে বললেন, ওখানে আমি খুব কষ্টে কিছু টাকা জমিয়ে রাখি। তোমার ভাবী মানিব্যাগের টাকা নিয়ে যায়। এগুলো আমার সম্পদ। খুব গোপন জিনিস। কেউ জানে না।
স্যার আমি জেনে গেলাম তো! তুমি তো আর আমার পকেট থেকে টাকা নিবে না। বলে হো হো করে হাসলেন। ওইদিন সন্ধ্যায় তিনি যেন কোথায় যাবেন সেজন্য টাকা আগেই বের করে রাখলেন যাতে ভুলে না যান!আর কাজটি করতে হলো ভাবী ফিরে আসার আগে!
যাক, পরিস্থিতি স্বাভাবিক। ইন্টারভিউ নেয়ার জন্য যথেষ্ট প্রেরণাদায়ক। ওই সময় তিনি তাঁর আত্মজীবনী লিখছিলেন। তাই পড়ার টেবিলে নানা ধরনের কাগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। জানালেন তিনি নিজে টাইপ করছেন। বহু রেফারেন্স আর খুঁজে পাচ্ছেন না। স্মৃতি থেকে লিখতে হচ্ছে। শুরু হলো কথা বলা। পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে তিনি অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। কোম্পানি সিনিয়র আন্ডার অফিসার অর্থাৎ ক্রসবেল্ট হোল্ডার ছিলেন। যতোদূর মনে পড়ে তিনি তাঁর কোর্সে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিলেন।১৯৫৮ সালের ২৭ এপ্রিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমিশন লাভ করেন। অফিসার হওয়ার পর সকল কোর্সে প্রথম স্থান অধিকার করেন। সমগ্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে স্টাফ কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হন। মুক্তিযুদ্ধে ৮ ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বিদ্রোহে সামিল হন। জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাথে ঝাপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। নিযুক্ত হন ৫ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসাবে। জেনারেল এরশাদ ১৯৮২ সালে সামরিক আইন জারী করে ক্ষমতা গ্রহন করলে তিনি এর প্রতিবাদ করেন। তাঁকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে এরশাদ বৃটেনে রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়ে দেন।
চমৎকার একটা ইন্টারভিউ দিলেন জেনারেল মীর শওকত যার সারমর্ম হলো- যেকোন স্বাধীন রাষ্ট্র তা যত ছোটই হোক তার সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। এ জন্য একটি কার্য়কর প্রতিরক্ষা মতবাদ সবদেশেই প্রণয়ন করা হয়। তবে আগ্রাসন প্রতিহত করা, যাকে প্রতিরক্ষাও বলা যায় তার অর্থ কিন্তু শুধুমাত্র এই নয় যে, এক দেশের আর্মি অন্য দেশ আক্রমণ করবে এবং আক্রান্ত দেশ তার সশস্ত্রবাহিনী দিয়ে সেটা প্রতিরোধ করবে। বরং আগ্রাসন শুধু সামরিক খাতে নয়, তা হতে পারে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে। তাই প্রতিরক্ষা বা ডিফেন্স শুধুমাত্র আর্মি দিয়েই হবে না। এজন্য রাষ্ট্রের ,সমাজের সকল পর্য়ায়েই আত্মরক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ইন্টারভিউ নেয়ার এক পর্য়ায়ে এক্সকিউজ মি বলে জে.শওকত ঘর থেকে কোথায় যেন গেলেন। কিছুক্ষণ পর ছোট একটা ট্রেতে দুই কাপ কফি হাতে নিয়ে ঢুকলেন। নিজেই কফি বানিয়ে এনেছেন। ভাবা যায়? এমন মানুষকে ভোলা যায়?
আলাপের বিভিন্ন পর্য়ায়ে তিনি অনেক না জানা ঘটনার উল্লেখ করলেন। কেন, কিভাবে জেনারেল জিয়া কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষনা দিয়েছিলেন সেটার কথা বললেন। একটি সুপারপাওয়ারের অজানা, কিন্তু তাৎপর্য়পূর্ণ অবস্থানের কথা উল্লেখ করলেন। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের একজন ‘টলম্যানের’ কথা নিয়ে চমকপ্রদ তথ্য দিলেন যা আগে বা পরে কখনো শুনিনি। আশ্চর্য়ান্বিত হলাম। তিনি এসব তাঁর আত্মজীবনীতে পুরোটা তুলে ধরবেন কিনা জানতে চাইলে বললেন, দেখি, তবে বিষয়টা খুব সেন্সিটিভ। জানি না তাঁর অন্যান্য সহযোদ্ধার ওইসব বিষয় সম্পর্কে অবগত আছেন কিনা? আমাকে নিষেধ করে দিলেন ওসব নিয়ে কথা বলতে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তিনি ঢাকায় ছিলেন। সেই বিপ্লব নিয়েও অনেক ‘কাহিনী’ বললেন। একজন বিশেষ ব্যক্তির একটা ঘটনা তো রীতিমতো হাস্যকর। দু’জনই হাসলাম মন খুলে।
দীর্ঘ সাক্ষাতকার শেষে আনঅফিসিয়ালি রাজনীতি নিয়ে আলাপ হলো কতোক্ষন। তিনি তখন বিএনপি’র নেতা। খুব দু:খের সাথে জানালেন, স্বাধীনতার বিরোধি কোন দল বা মানুষ যদি বিএনপি’র সাথে যুক্ত হয়, এমনকি জোটভুক্ত হয় তাহলে আমার ও মুক্তিযোদ্ধাদের মর্য়াদা আর থাকে কোথায়? আমি অন্তত একজন বীর উত্তম হিসাবে তো তা মানতে পারি না। যদি তা মেনে নেই তাহলে ইতিহাসে আমাকে ভিন্ন ভাবে চিহ্নিত করা হবে। তবে, বীর উত্তম জেনারেল জিয়ার স্ত্রী হিসাবে বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি তাঁর সম্মান সবসময় থাকবে।
স্যারের বেশক’টা কুকুর ছিল। তিনি প্রায়ই সেসব প্রভুভক্ত কুকুরগুলো নিয়ে আশপাশে ঘুরতে বের হতেন। আমি কুকুর ভয় পাই জেনে তিনি আমাকে ‘এফ্রেইড লাইক মাউস’ বলে মৃদু তিরষ্কার করেছিলেন।
ইন্টারভিউটি ২০০০ সালের ২৮ এপ্রিল দৈনিকে প্রকাশিত হয়। এরপর জেনারেল শওকতের সাথে বহুবার দেখা হয়েছে। হিউমারাস কন্ঠে দরাজ দিল নিয়ে স্নেহ করতেন। শেষ বার দেখা হয় ২০১১ সালের সশস্ত্রবাহিনী দিবসে সেনাকুঞ্জে অনুষ্ঠিত রিসিপশনে। তার ক’দিন আগে তাঁর একমাত্র পুত্র মারা যায়। জেনারেল শওকতকে সেদিন সালাম দেয়ার পর বেশ ভেঙ্গে পড়েছেন বলে মনে হয়েছিল। হ্যান্ডশেক করে আমার পরিবারের খোঁজ নিয়েছিলেন যথারীতি। আজ তিনি নেই। তাঁর সেই ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারাটা সবসময় স্মৃতিতে ঠিকই আছে।এমন মানুষ হয়তো আর আমাদের ইতিহাসে তৈরি হবে না, এমন অফিসারও আসবে না। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

This site uses cookies. By continuing to browse the site you are agreeing to our use of cookies & privacy Policy from www.prothom.news