আর্জেন্টিনার আদালতে সাক্ষ্য দিচ্ছেন রোহিঙ্গারা

মিয়ানমারে দমন-পীড়ন

আর্জেন্টিনার আদালতে সাক্ষ্য দিচ্ছেন রোহিঙ্গারা

প্রথম নিউজ, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ২০১৭ সালে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ রাখাইনে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ওপর যে ভয়াবহ নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে দেশটির সামরিক বাহিনী, সে সম্পর্কে বিচার বিভাগীয় তদন্ত শুরু করেছে দক্ষিণ আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ আর্জেন্টিনা। সেই তদন্তের অংশ হিসেবে এই প্রথমবার দেশটির আদালতে সশরীরে সাক্ষ্য দেবেন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা।

রাজধানী বুয়েন্স এইরেসের একটি আদালতে এ বিষয়ক একটি মামলা আছে এবং প্রায় ২ বছর স্থগিত থাকার পর ফের শুরু হয়েছে সেটির তদন্ত কার্যক্রম। তদন্তের অংশ হিসেবে গত ৭ জুন, বুধবার থেকে মামলার সাক্ষীদের আদালতে সশরীরে হাজির হয়ে সাক্ষ্যপ্রদান পর্ব শুরু হয়েছে। আগামী ১৩ জুন পর্যন্ত পর্ব চলবে বলে বার্তাসংস্থা এএফপিকে জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যভিত্তিক রোহিঙ্গা সংহতি সংস্থা বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকে’র প্রেসিডেন্ট মাউং তুন খিন।

বুয়েন্স এইরেসের যে আদালতে এই মামলার বিচারকাজ চলছে, সেখানকার একটি সূত্র এএফপিকে জানিয়েছে, আদালতের রুদ্ধদ্বার কক্ষে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হচ্ছে। আগামী ১৩ তারিখ পর্যন্ত চলবে এই সাক্ষ্যগ্রহণ। আশা করা হচ্ছে— অন্তত ৬ জন রোহিঙ্গা প্রতিনিধি সশরীরে সাক্ষ্য দিতে হাজির হবেন বুয়েন্স এইরেসের সেই আদালতে। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে মামলার পরবর্তী পর্বের পদক্ষেপ নেবেন আদালত।

এদিকে, মামলার তদন্ত কার্যক্রমের এই পর্ব শুরু হওয়ায় উচ্ছ্বসিত মাউং তুন খিন বুধবার এএফপিকে বলেন ‘অবশেষে রোহিঙ্গারা সশরীরে সাক্ষ্য দেবেন বুয়েন্স এইরেসের আদালতে। মামলায় এটা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রমাণ (এভিডেন্স) হিসেবে কাজ করবে। বার্মার সমস্ত নাগরিকদের জন্য আজ একটি ঐতিহাসিক দিন,’ বুধবার এএফপিকে বলেন মাউং তুন খিন।

বুয়েন্স এইরেসে যারা সাক্ষ্য দিতে যাবেন— তারা সবাই বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকে’র সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে তাদের কারোর নাম প্রকাশ করেননি মাউং। আর্জেন্টিনার সংবিধানে সার্বজনীন ন্যায়বিচারের (ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশন) নীতিমালাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যেসব দেশ সার্বজনীন ন্যায়বিচারের নীতিমালাকে স্বীকৃতি দিয়েছে— তারা বিশ্বের যে কেনো প্রান্তে যে কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর ওপর চালানো নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা ও বিচারবিভাগীয় তদন্ত পরিচালনা করতে পারে।

২০২১ সালে আর্জেন্টিনার সরকার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বুয়েন্স এইরেসের সেই আদালতে প্রথমবারের মতো মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের অভিযোগে দেশটির সেনাবাহিনীকে অভিযুক্ত করে মামলা করে। সে সময় ভার্চুয়াল মাধ্যমে ৬ জন রোহিঙ্গা নারীর সাক্ষ্যও গ্রহণ করা হয়েছিল। এই নারীরা সবাই ২০১৭ সালে আরাকানে সেনাবাহিনীর চলমান অভিযানের নির্যাতন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন।

তবে তারপর আর্জেন্টিনার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের কারণে এই মামলার তদন্ত কার্যক্রম দীর্ঘদিন স্থবির ছিল। সম্প্রতি ফের শুরু হয়েছে এই তদন্ত কার্যক্রম। আর্জেন্টিনা যে এই প্রথম আন্তর্জাতিক কোনো ইস্যুতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করছে— এমন নয়। এর আগেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে মামলা ও তদন্ত করেছে দেশটির বিচার বিভাগ। সেসবের মধ্যে স্পেনের সাবেক স্বৈরশাসক ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর শাসনামলে দেশটির জনগণের ওপর চলা নিপীড়নের তদন্তটি উল্লেখযোগ্য।

২০১৭ সালের আগস্টে আরাকানে কয়েকটি সেনাছাউনি ও পুলিশস্টেশনে একযোগে বোমা হামলা হয়। মিয়ানমারভিত্তিক সশস্ত্র রোহিঙ্গাগোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) সেই হামলার দায় স্বীকারও করে। এই ঘটনার জেরে আরাকানে সাধারণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগে পরিপূর্ণ সেই অভিযানের সামনে টিকতে না পেরে আরাকান থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার কুতুপালং ইউনিয়নের শরণার্থী শিবিরে এখনও আশ্রিত অবস্থায় আছেন তারা।