অস্থির ফলের বাজার

বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে বাজারে ফলের চরম সংকট দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া আসন্ন রমজান মাসে ফলের ক্রাইসিস তৈরির আশঙ্কাও করছেন তারা।

অস্থির ফলের বাজার
অস্থির ফলের বাজার

প্রথম নিউজ, অনলাইন : ডলার সংকটে পণ্য আমদানি করতে ছোট ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে ফল ব্যবসায়ীদের নানামুখী অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। এলসি খুলতে পারলেও তা খুবই সীমিত। এতে ফল আমদানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাজারে। এ কারণে    ফলের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিক্রেতারা চড়ামূল্যে ফল বিক্রি করে অতি মুনাফা তুলে নিচ্ছেন। ক্রেতারাও তাদের কাছে এক প্রকার জিম্মি। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে বাজারে ফলের চরম সংকট দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া আসন্ন রমজান মাসে ফলের ক্রাইসিস তৈরির আশঙ্কাও করছেন তারা।  রাজধানীর ফল আমদানিকারকরা বলছেন, গত বছরজুড়ে ডলারের বাজারে অস্থিরতা ছিল চরমে। এতে ফল আমদানি গুরুতরভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানির ক্ষেত্রে জাহাজ ভাড়াসহ পরিবহন খরচও বেড়ে যায়।

সবমিলিয়ে আমদানি করা ফলের বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এদিকে গত জুনে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৯৩ টাকা। ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৭ টাকা। আলোচ্য সময়ে ডলারের দাম বেড়েছে ১৪ টাকা বা ১৫ শতাংশ। মূলত ডলারের দাম বাড়ার কারণে আমদানিতে সব খাতে খরচ বেড়েছে। আমদানিকারক শাহিনুর রেজা বলেন, ডলার সংকটের কারণে বর্তমানে শুধু খাদ্যদ্রব্য আমদানির জন্য এলসি দেয়া হচ্ছে। অন্য পণ্য আমদানির এলসি করা যাচ্ছে না। ফল আমদানির ক্ষেত্রে গাড়ির চাকা অনুযায়ী শুল্কায়ন করা হয়। এ কারণে স্থলবন্দর দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ফল আমদানি বন্ধ রয়েছে। 

ঢাকা মহানগর ফল আমদানি-রপ্তানিকারক ও আড়তদার ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম শেখ বলেন, এক বছর আগের তুলনায় এখন ফল আমদানি কমেছে অর্ধেকের বেশি। বর্তমানে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। আবার সব ধরনের জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচে লাগাম টেনেছে সাধারণ মানুষ। এ কারণে বিক্রিও কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে ফল আমদানির এলসি খোলা ২৭ কোটি ডলার থেকে কমে ১৫ কোটি ডলারের নেমেছে। কমেছে ৪৪ শতাংশ। একই সময়ে আমদানি ২১ কোটি ডলার থেকে কমে ১৩ কোটি ডলারে নেমেছে। আমদানি কমেছে ৩৫ শতাংশ। ডলার সাশ্রয় করতে ফলের আমদানি কমাতে এর ওপর শতভাগ মার্জিনসহ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এতে আমদানি কমেছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে ফলের দাম গড়ে ২৬ শতাংশ বেড়েছে। বেশ কয়েকটি দেশ ফল রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে।

এদিকে রমজান সংশ্লিষ্ট পণ্যের আমদানি বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আরও কিছু পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এলসি খোলা ও আমদানির প্রক্রিয়ায় বিশেষ তদারকি করছে তারা। এজন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের শাখা থেকে ব্যাংকগুলোয় খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমদানিকারকরা আরও জানান, সরকার ফল আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপের পর থেকে ব্যাংকগুলো ঋণপত্র খোলা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিল। এরপর গত বছরের মাঝামাঝি থেকে আমদানি কমতে থাকে। জানা যায়, ছোট ব্যবসায়ীদের নিজস্ব রপ্তানি আয় নেই। ফলে তারা ডলার পাচ্ছেন না। ব্যাংকও তাদের ডলার দিচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চাহিদা অনুযায়ী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ডলার না দেয়ায় তারা এলসি খুলতে পারছে না। ছোট ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগই স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি করেন। গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে স্থলবন্দরগুলো দিয়ে পণ্য আমদানি কমে গেছে।

উল্লেখ্য, দেশে ডলার-সংকট দেখা দেয়ায় গত বছরের মে মাসের শেষ সপ্তাহে ফল আমদানিতে নিরুৎসাহিত করতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পরে ফল আমদানিতে ঋণ সুবিধাও বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকে আমদানিকারকদের নগদ টাকায় ফল আমদানি করতে হচ্ছে। আবার আমদানির খরচও বেড়ে গেছে। 
চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১লা জুলাই থেকে ২৪শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদেশি ফলের মধ্যে আপেল, কমলা, ম্যান্ডারিন (ছোট কমলা), আঙ্গুর ও নাশপাতি আমদানি হয়েছে ৯৩ হাজার ৩৬১ টন। এর আগের বছরের একই সময়ে এই পাঁচ ধরনের ফলের আমদানি হয়েছিল ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩০৬ টন। অর্থাৎ আমদানি নিরুৎসাহিত করার উদ্যোগের ফলে আমদানি কমেছিল ৪৫ হাজার ৯৬৫ টন বা ৩৩ শতাংশ। উল্লিখিত পাঁচ ধরনের ফলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি কমেছে আপেল, কমলা ও আঙ্গুরের।

রাজধানীর বাদামতলী ফল বাজারের আমদানিকারকরা বলছেন, ফলের আমদানি কমে যাওয়ায় তাদের ব্যবসাও কমে গেছে। ডলারের বাড়তি দাম ও আমদানি কমার কারণে বাজারে ফলের দাম ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।  কাওরান বাজারের পাইকারি ফল ব্যবসায়ী মিন্টু মিয়া বলেন, মাঝে কয়েকদিন ফলের দাম বাড়তি দামে স্থিতিশীল ছিল। এখন আবার অস্থির। ফলে দৈনিক বেচাকেনা ৪০ শতাংশের মতো কমে গেছে। সামনে যদি আমদানি ব্যাহত হয়, তাহলে বাজারে আরও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

ব্যবসায়ীদের আমদানির হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ১৬ লাখ ৮৮ হাজার কেজি বিদেশি ফল খাচ্ছে দেশের মানুষ। বছরের পাঁচ মাস, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি চলে বিদেশি ফল। কারণ, এ সময়ে দেশীয় ফলের সরবরাহ কম থাকে। বিদেশি ফলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় আপেল। এর পরের অবস্থান মাল্টার। এ দুটি ফলের বাইরে কমলা, ডালিম, আঙ্গুর, নাশপাতি ও লেবুজাতীয় ফল আমদানি হয়। সব মিলিয়ে এক বছরে বিদেশি ফল আমদানি হয় ৬ থেকে ৭ লাখ টন। এরমধ্যে আমদানির ৭৭ শতাংশই হয় আপেল ও মাল্টা।

বাজারে আপেল, কমলা, আঙ্গুর, আনার বা ডালিম, খেজুর, মাল্টা এসব ফল অতি উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। মাস খানেক আগে আপেল ছিল কেজিপ্রতি ১২০ টাকা থেকে প্রকারভেদে ১৬০ টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকায়। আঙ্গুরের দাম ছিল ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। এখন বিক্রি করা হচ্ছে ৩০০ টাকা থেকে ৩৬০ টাকা পর্যন্ত। খুচরা বাজারে মাল্টা বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা। একলাফে সেটা এখন ২০০ টাকা থেকে ২৮০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। কমলার বাজার দরও প্রায় একই। আনারের দাম ৩০০ থেকে ৬৬০ টাকা। খেজুরের হরেক রকম দাম লক্ষ্য করা গেছে। ২০০ টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হচ্ছে। 

কাওরান বাজার কাঁচাবাজারের সামনে আঙ্গুর (সাদা) ৩০০ থেকে ৩৬০ টাকা, আঙ্গুর (কালো) ৩০০ থেকে ৫৫০ টাকা, আপেল ২০০ থেকে ৩৫০ টাকা ও মাল্টা কেজি প্রতি ৩০০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। কমলা কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২৫০ টাকায়। মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। নাশপাতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়। ভালো মানের খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকায়। সুপারশপ বা বিশেষায়িত দোকানগুলোতে দাম আরও বেশি।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: