অ্যানেসথেসিয়া ছাড়াই অস্ত্রোপচার, মিল্টনের লোমহর্ষক জবানবন্দি
ডিবি জানিয়েছে, মিল্টন শুধু রোগীদেরই মারধর করতেন না। তার অফিসের স্টাফ, রোগীর স্বজন, বাহকদেরও মারধর করতেন।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: বিনা চিকিৎসায় ও অযত্ন-অবহেলায় রাস্তাঘাটে-ফুটপাথে থাকা অনেক অসহায় মানুষের শরীরে পচনসহ নানা ধরনের রোগের সৃষ্টি হতো। এসব অসহায় মানুষের ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ আশ্রমে ঠাঁই দিতেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দার। কিন্তু আশ্রমে ঠাঁই পাওয়া গরিব, অসহায় মানুষের শরীরে পচন সারাতে অ্যানেসথেশিয়া ছাড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানের নিয়মনীতি অনুসরণ না করে নিজেই অপারেশন করতেন। নিজে অসহায় রোগীদের হাত, আঙ্গুল, শরীরের মাংস ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলতেন। ব্লেড ছুরি দিয়ে কাটাছেঁড়ার কারণে তারা কষ্টে আর্তনাদ করতেন। এসব অসহায় মানুষের কান্নাকাটি, চিৎকারে আশেপাশের মানুুষ সজাগ হয়ে যেতেন। প্রতিবেশীদের অনেকেই ছুটে এসে কান্নাকাটির কারণ জিজ্ঞাসা করতেন। মিল্টন তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে তাড়িয়ে দিতেন। আর অপারেশন করে অসহায় রোগীদের রক্ত ঝরিয়ে হাত-পা কেটে পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করতেন। যখন এসব অস্ত্রোপাচার করতেন তার আগে মিল্টন নেশা করতেন।
সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত এবং মানবতার ফেরিওয়ালা নামধারী মিল্টন সমদ্দারের মিরপুর থানার মামলার তিনদিনের রিমান্ড শেষ হয়েছে গতকাল। রিমান্ডে মিল্টন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে এমন লোমহর্ষক জবানবন্দি দিয়েছেন। স্বীকার করেছেন তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ। রিমান্ড শেষে তাকে আদালতে হাজির করেন তদন্ত কর্মকর্তা। পরে মানব পাচার আইনের আরেকটি মামলায় রিমান্ড চাইলে তার ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, আশ্রমে থাকা অসহায় মানুষ ও রোগীদের নানাভাবে যেকোনো ইস্যুতে অমানবিকভাবে নির্যাতন করতেন। অস্ত্রোপচার করার আগে রোগীদের অ্যানেসথেশিয়া করা লাগলেও তিনি এসব না করে ব্লেড, ছুরি দিয়ে নিজেই অপারেশন করতেন। এতে করে রোগীরা অস্ত্রোপচারের সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে আর্তনাদ করতো। আর্তনাদ করলেও তাদের টর্চার করতেন মিল্টন। মারধর করে কান্নাকাটি থামাতেন। অনেক সময় পিটিয়ে নিস্তেজ করে দিতেন। রিমান্ডে তদন্ত কর্মকর্তারা মিল্টনকে জিজ্ঞাসা করেছিল তিনি কেন এসব মানুষদের অমানবিকভাবে নির্যাতন ও অপারেশন করতেন। মিল্টন জানিয়েছে, তিনি যেসব রোগীদের আশ্রমে ঠাঁই দিতেন তাদের অনেকেই মানসিক, শারীরিক প্রতিবন্ধী। অনেকের শরীরে এতটাই পচন ধরতো কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকতো না। তাই তিনি নিজেই অপারেশন করে এসব পচা হাত পায়ের মাংস কেটে ফেলতেন। কাটার সময় অনেকেই ব্যথায় ও রক্তক্ষরণে কষ্ট পেতেন। এজন্য তারা আর্তনাদ করতেন। তাই তাদের কান্নাকাটি থামানোর জন্য মারধর করতেন। এ ছাড়া তাদের আর্তনাদ, কান্নাকাটি ও রক্তপাতে তিনি পৈশাচিক আনন্দ পেতেন। ডিবি এসবের সত্যতাও পেয়েছে। তার টর্চার সেল থেকে আলামত ব্লেড ছুরি জব্দ করেছে।
ডিবি জানিয়েছে, মিল্টন শুধু রোগীদেরই মারধর করতেন না। তার অফিসের স্টাফ, রোগীর স্বজন, বাহকদেরও মারধর করতেন। আশ্রমে এসে অনেকেই অসহায় মানুষের দেখতে যেতেন। তাদেরকেও মারধর করতেন। অনেক সময় ফোন করে অকথ্য ভাষায় বকাবকি করতেন। অনেক সেলিব্রেটিরাও তার আশ্রমে গিয়ে অপমান অপদস্ত ও মারধরের শিকার হয়েছেন। কিন্তু মানবিক কাজ করার জন্য কেউ তাকে কিছু বলতেন না। শুধু তাই নয় সমাজের অনেক উচ্চ পর্যায়ের লোকদের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। এসব প্রভাব কাটিয়ে মিল্টন মানুষের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতেন।
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, মিল্টন সমাদ্দার ভয়াবহ অপরাধ করেছেন। একটি দুটি অপরাধ করেননি, তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ তো ভয়াবহ। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। তার অ্যাকাউন্টে এখনো ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা আছে। এতগুলো টাকা থাকার পরও তিনি কাউকে চিকিৎসা করাননি। নিজেই হয়ে গেছেন অপারেশন থিয়েটারের হেড। তার অপারেশন থিয়েটারে থাকতো একটা ছুরি ও কিছু ব্লেড। তিনি এগুলো দিয়েই নিজেই অপারেশন করাতেন। এরকম ভয়াবহ, অমানবিক আচরণ, অসভ্য আচরণ, এটা বাংলাদেশের মানুষের জন্যই তো লজ্জাজনক। যারা তার সঙ্গে জড়িত, যারা পেট্রনাইজড্ করেছে, সহযেগিতা করেছে, ফেসবুকে ফলোয়ার বাড়ানোর জন্য যারা পেট্রন করেছে, ফাউন্ডেশনের মেম্বার তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
তিনি বলেন, সে উজিরপুর থেকে বাবা পিটিয়ে ঢাকায় এসে ওষুধের দোকানে চুরি করেছে, এরপর একটা আশ্রম গড়ে তোলেন। যেখানে তিনি অসহায়, গরিব শিশু, বৃদ্ধ, প্যারালাইজ্ড, বাকপ্রতিবন্ধী, মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে সংগ্রহ করে আশ্রমে নিতেন। তাদের দেখিয়ে তিনি ফেসবুকে ফলোয়ারের মাধ্যমে টাকা ইনকাম করতেন। সেই টাকা আবার তিনি খরচ করতেন না। তার আশ্রমে ৯০০ লোক মারা গেছে বলে নিজেই প্রচার করতেন উল্লেখ করে হারুন বলেন, মানুষগুলো মারা গেছেন। জানাজা হলো না, রাতের অন্ধকারে কবর দেয়া হলো, আত্মীয়-স্বজনকে জানানো হলো না, মিথ্যেভাবে সিল স্বাক্ষর দিয়ে নিজেই ডেথ সার্টিফিকেট দিলেন, স্বজনদের জানালেন না, এসবই আমাদের তদন্তে আসবে। মিল্টন সমাদ্দার নিজেই বলেছেন, ৯০০ লোকের প্রাণ নিভে গেল! কীভাবে নিভে গেল? তিনি তো তাদের হাসপাতালে নেননি, ডেথ সার্টিফিকেটও নেননি, থানা পুলিশকে অবহিত করেননি। আবার ৯০০ লোকের প্রাণ যাবার যে কথা তিনি বলেছেন, সেটা আদৌ সত্য কিনা, নাকি এটা টাকা ইনকামের একটা কথার কথা! সত্য হলে কি করেছেন। সব তদন্তে নিয়ে আসবো। এই আশ্রমের সঙ্গে আরও যারা যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
৯০০ লোকের মৃত্যু সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে মিল্টন সমাদ্দার ডিবি পুলিশকে জানিয়েছে, আসলে ৯০০ মানুষ মরেনি। তাহলে কতোজন মারা গেছে? বলেন ১৩৫ জন মারা গেছে। আসলে ৯০০ লোক মারা গেছে। তাদের দাফন করেছি। সেটারও তিনি রেজিস্ট্রার্ড সংগ্রহে রাখেননি। যারা মারা গেলেন তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়নি। এতগুলো মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে অবশ্যই তাকে জবাব দিতে হবে। হারুন বলেন, অটিজম শিশুদের সঙ্গে যা করা হয়েছে তা লজ্জাজনক। অটিজমের নাম ধারণ করে অসহায়, বাক প্রতিবন্ধী ভারসাম্যহীন মানুষ সংগ্রহ করে ফেসবুকে প্রচার করে ফলোয়ারদের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে আত্মসাৎ করেছেন। অন্যদিকে তিনি সেই টাকা খরচা করেননি। তাকে জবাবদিহি করতে হবে। তিনি কীভাবে ডেথ সার্টিফিকেট দিতেন। আমরা তো সেখানে যাতায়াত করা ডাক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তিনি বলেছেন, মিল্টন সমাদ্দার তার সিল স্বাক্ষর জালিয়াতি করে ডেথ সার্টিফিকেট দিতেন। যা তিনি জানতেন না। মিল্টন সমাদ্দার নিজেও তা স্বীকার করেছেন।