অপ্রদর্শিত অর্থ আরও বৃদ্ধির শঙ্কা!

  বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, এবারের বাজেটে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে যে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে তা অপব্যবহার হতে পারে।

অপ্রদর্শিত অর্থ আরও বৃদ্ধির শঙ্কা!
ফাইল ফটো

প্রথম নিউজ, ঢাকা: বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ নামমাত্র রাজস্ব দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগে বিস্মিত বিশেষজ্ঞরা। এতে অর্থ পাচারের পরিমাণ আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তাদের। পাচারকারীদের সাধারণ ক্ষমা নয়, এ ধরনের অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার পরামর্শ দেন তারা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্যে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তার মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের কারণে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবের কোনো যুক্তি খুঁজে পান না অর্থনীতিবিদরা। 

তাদের মতে, সরকারের এ পদক্ষেপে অসৎ ব্যক্তিরা আরো বেশি করে অর্থ পাচারের দিকে ঝুঁকে পড়বেন। কারণ সৎ করদাতাদের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ কর দিতে হয়। আর অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের জন্য ৭ শতাংশ দিয়ে কর দিয়ে বিদেশ থেকে অর্থ দেশে ফেরত আনতে পারে। তাই অসৎ লোকেরা এখন তাদের অপ্রদর্শিত অর্থ আনঅফিসিয়াল চ্যানেলের মাধ্যমে বিদেশে পাঠাতে পারে। তাছাড়া এ ধরনের অর্থ বা সম্পদের উৎস সম্পর্কে জবাবদিহি না থাকা সৎ করদাতাদের জন্য অত্যন্ত অনৈতিক ও অন্যায়।

জাতীয় সংসদে গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী ২০২২-২৩ অর্থবছরের পৌনে ৭ লাখ কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, তাতে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে আয়কর অধ্যাদেশে নতুন বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব করেছেন। তাতে বিদেশে অবস্থিত কোনো সম্পদের ওপর কর পরিশোধ করা হলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ সরকারের কেউ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তুলবে না। এরপর এ বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিদেশি শিল্প-উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সংগঠন ফরেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফআইসিসিআই)। 

পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগকে এফআইসিসি পাচারকারীদের ‘সাধারণ ক্ষমা’ হিসেবে অবিহিত করে বলেছে, ‘এই ধরনের ক্ষমাকে আমরা কোনোভাবেই সমর্থন করি না। এটি আরো বেশি অর্থ দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে পারে।

বাংলাদেশ থেকে গত ১০ বছরে দেশের বাইরে পাচার হয়েছে সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা। এই অর্থ বাংলাদেশের বাজেটের সমান। স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশগুলোর মধ্যে অর্থ পাচার সবচেয়ে বেশি হয়েছে বাংলাদেশ থেকেই। 

গত ২ মে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) অর্থ পাচারের যে তথ্য প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায় ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯১১ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। বলা হয়েছে, আমদানি-রপ্তানিতে আন্ডার ভয়েস এবং ওভার ভয়েসের মাধ্যমেই প্রধাণত এই অর্থ পাচার করা হয়। এবারের প্রতিবেদনে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সালের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। 

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা।
 
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, এবারের বাজেটে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে যে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে তা অপব্যবহার হতে পারে। পাচারের অর্থ মানুষের হক উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন তাতে দুষ্কৃতকারীরা প্রশ্রয় পেতে পারে। তাছাড়া এত সামান্য করের মাধ্যমে পাচারকারীদের অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করবে।

তিনি এবারের বাজেটে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার প্রস্তাবটি পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে বলেন, অর্থমন্ত্রীকে এর বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে। দেশের অর্থনীতিতে অভিবাসীদের অবদান বিবেচনায় তাদের প্রতি আরো সদয় হতে হবে। রেমিট্যান্সের ওপর ২.৫% প্রণোদনার সুযোগে মানিলন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িতরা উপকৃত হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদের মতে, অর্থমন্ত্রীর এ প্রস্বাবে যারা দেশের বাইরে অর্থ পাচার করেছে তারা তা ফেরত আনতে উৎসাহ বোধ করবে না। তিনি মনে করিয়ে দেন, অঘোষিত অর্থ ও সম্পদকে মূলধারার অর্থনীতিতে ফিরিয়ে আনার জন্য অতীতে পরপর সরকারগুলো অভ্যন্তরীণভাবে অনেক অনুষ্ঠানে সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু তার সাফল্য ছিল নগণ্য।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার জন্য সাধারণ ক্ষমার ঘোষণায় তিনি বিস্মিত হয়েছেন। তার মতে এই জাতীয় অর্থ বা সম্পদের উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা না করা সৎ করদাতাদের জন্য অত্যন্ত অনৈতিক এবং অন্যায্য। এ ধরনের অপরাধীদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা উচিত।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom