হাতিয়ার লাশকাটা ঘর নিজেই যেন লাশ!
ডোম সংকটে ১৭ বছর ধরে বন্ধ ময়নাতদন্ত কার্যক্রম। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০০৬ সাল থেকে শূন্য পড়ে আছে ডোমের পদটি।
প্রথম নিউজ, নোয়াখালী: নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার লাশকাটা ঘর নিজেই যেন লাশ হয়ে পড়ে আছে। ডোম সংকটে ১৭ বছর ধরে বন্ধ ময়নাতদন্ত কার্যক্রম। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০০৬ সাল থেকে শূন্য পড়ে আছে ডোমের পদটি। ডোম অনিল চন্দ্র দাসের মৃত্যুর পরে আর কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তাই অযত্নে ও অবহেলায় পড়ে আছে ডোম ঘরটি, বন্ধ রয়েছে ময়নাতদন্তও।
জানা যায়, কারো অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে বা কারো মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ হলে মৃত্যুর কারণ জানার জন্য ময়নাতদন্তের প্রয়োজন হয়। কিন্তু নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় কোনো মানুষের অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে মৃত্যু ঘটলে ময়নাতদন্তের জন্য পুলিশ ও স্বজনদের দুর্ভোগের শেষ থাকে না। কারণ হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ময়নাতদন্ত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। এক সময় হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ময়নাতদন্ত করার সুযোগ ছিল। কিন্তু ২০০৬ সালের দিকে ডোম মারা যাওয়া ও স্পেশালিস্টের অভাবে এ কার্যক্রমটি বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর থেকে এখানে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত, অপমৃত্যু, হত্যা, বিকৃত মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য নোয়াখালী জেলা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাতিয়ার সঙ্গে নোয়াখালীর যোগাযোগের মাধ্যম নদীপথ হওয়ায় ঘুর্ণিঝড় ও যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মরদেহ নিয়ে মৃতের স্বজন ও স্থানীয় পুলিশকে পড়তে হয় চরম দুর্ভোগে।
হাতিয়ার বাসিন্দা আলতাফ হোসেন বলেন, ময়নাতদন্তের জন্য হাতিয়া থেকে একটা মরদেহ জেলা শহরে নিতে অনেক ব্যয়বহুল এবং কষ্টকর। প্রায় সময় নদী উত্তাল থাকে তখন মরদেহ নিয়ে যাওয়া আসা কঠিন হয়ে যায়। অনেক অর্থেরও প্রয়োজন হয়। ময়নাতদন্তের ঘর চালু হলে এমন ভোগান্তি আর থাকবে না।
প্রয়াত ডোম অনিল চন্দ্র দাসের ছেলে রাজিব চন্দ্র দাস বলেন, আমার বাবা যেদিন মারা গেছেন সেদিনও ময়নাতদন্তের কাজ করেছেন। তিনি ২০০৬ সালে মারা যান। সে থেকে ময়নাতদন্ত কার্যক্রম বন্ধ আছে। এই দ্বীপ অঞ্চল থেকে একটা মরদেহ জেলা শহরে নিয়ে আসা খুবই কষ্টকর। রোগীর স্বজনের ভোগান্তির শেষ নেই। এখানে ডোম সংকট নিরসন হলে মানুষের ভোগান্তি কমবে।
হরণি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আখতার হোসেন বলেন, মরদেহ নিয়ে হাতিয়ায় যারা পরিবহন করে তাদের পরিবারের সকল সদস্যের ভাড়া আমাদের সাবেক সংসদ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী সাহেব দেন। নদীপথে পরিবহনে কোনো অর্থের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু জেলা শহরে যেতে আসতে অনেক কষ্ট হয় এবং অনেক টাকার প্রয়োজন হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ময়নাতদন্ত কার্যক্রম চালু হলে মানুষের ভোগান্তি কমবে।
হাতিয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমির হোসেন বলেন, হাতিয়া একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এখানে সাত লাখের বেশি মানুষের বসবাস। যদি অপরাধের সঙ্গে জড়িত মরদেহ পাই তাহলে নদী পার হয়ে জেলা শহরের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নিতে হয়। নদী ভালো থাকলে দুদিন সময় লাগে আর উত্তাল থাকলে তিন দিন বা তার থেকে বেশি সময় লাগে। ব্যয় সাপেক্ষ হওয়ায় দ্বীপাঞ্চলের অনেকের পক্ষে কষ্ট হয়ে যায়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আগে ডোম ছিল। এটি চালু হলে সবার সুবিধা হবে। একজন চিকিৎসক ও একজন ডোম নিয়োগ দিয়ে ময়নাতদন্ত কার্যক্রম দ্রুত চালু করলে মানুষের ভোগান্তি যেমন কমবে তেমনি আমরাও আইনশৃঙ্খলার কাজ দ্রুত করতে পারব।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সৌমেন সাহা বলেন, যেহেতু এটি বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড তাই হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই ডোম ও ফরেনসিক চিকিৎসক ছিল। ২০০৬ সালে ডোম মারা যাওয়ার পর থেকে এ কার্যক্রম বন্ধ আছে। এতে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। আমরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আশা করি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দ্রুত একজন ফরেনসিক চিকিৎসক ও একজন ডোম নিয়োগ দিয়ে হাতিয়াবাসীর কষ্ট লাঘব করবেন।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার বলেন, বাংলাদেশের কোনো উপজেলায় ময়নাতদন্ত কার্যক্রমের ব্যবস্থা নেই। তবে যেহেতু এটি দ্বীপ উপজেলা তাই এখানে পুনরায় চালু করার জন্য আমরা আবেদন করেছি কিন্তু অনুমোদন পাইনি। এছাড়া ১০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের আবেদন করা হয়েছে সেটিও যদি অনুমোদন পায় তাহলে ময়নাতদন্ত কার্যক্রম চালু হবে। এটা আবার সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।