স্বর্ণ চোরাচালানিতে রেমিট্যান্স হারাচ্ছে নেপাল, সংকটে অর্থনীতি
প্রথম নিউজ. ডেস্ক : ২৯ নভেম্বর, ২০২১। কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সেদিন বিদেশফেরত কয়েকজনের কাছ থেকে জব্দ করা হয় ২১ কেজি স্বর্ণ। অভিযোগ, তারা নেপাল সরকার নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি স্বর্ণ নিয়ে দেশটিতে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন। এতে কাস্টমস কর্মকর্তারা অনেকটা চমকে ওঠেন। কারণ, তারা একদিনে যে পরিমাণ অবৈধ স্বর্ণ জব্দ করেছেন, তা নেপালের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর দৈনিক আমদানি সীমার চেয়েও বেশি।
নেপালে স্বর্ণ আমদানির অনুমতি রয়েছে কেবল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এবং এর সর্বোচ্চ সীমা দৈনিক ২০ কেজি নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। নেপাল রাষ্ট্র ব্যাংকের অর্থনৈতিক গবেষণা বিভাগের প্রধান প্রকাশ কুমার শ্রেষ্ঠার মতে, দেশটিতে অনুষ্ঠানিকভাবে যে পরিমাণ স্বর্ণ প্রবেশ করছে এবং বিমানবন্দরে প্রতিদিন জব্দ হচ্ছে, তা থেকে বোঝা যায়, নেপালের রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার পেছনে এটিই অন্যতম কারণ।
বিদেশে কর্মরত প্রবাসীরা স্বর্ণ কিনতে অর্থ খরচ করলে তাদের স্বদেশে পাঠানো টাকার পরিমাণ কমে যায়। আর নেপালের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত নেপালি কর্মীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্স।
নেপালের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি শুরু হওয়া ২০২১-২২ আর্থিক বছরের শুরুতেই টানা তিন মাস দেশটির রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে। অথচ একই সময়ে বিভিন্ন দেশে তাদের কর্মী পাঠানো অনেকটাই বেড়েছে। ভারত-মালয়েশিয়ার পাশাপাশি উপসাগরীয় দেশগুলো নেপালের অভিবাসী কর্মীদের অন্যতম প্রধান গন্তব্য।
নেপাল রাষ্ট্র ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে নেপালিদের রেমিট্যান্স পাঠানো ৭ দশমিক ৬ শতাংশ কমে গেছে। এ তিন মাসে তারা ২৩ হাজার ৯৩২ কোটি নেপালি রুপি স্বদেশে পাঠিয়েছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথম দুই মাসেই তাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছিল যথাক্রমে ১৮ দশমিক ১ শতাংশ এবং ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। অথচ একই সময়ে বিদেশে কাজ করার জন্য অনুমতি নেওয়া নেপালিদের সংখ্যা বেড়ে ৬৬ হাজার ৩১৬তে পৌঁছেছিল।
নানা ধরনের পণ্য রপ্তানির পাশাপাশি নেপালের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম বড় উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। এর গতি কমে যাওয়ায় তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও টান পড়েছে। তাতে অর্থনৈতিক সংকটের আশঙ্কায় কপালে ভাঁজ পড়েছে নেপাল সরকারের।
রেমিট্যান্স প্রবোহের মতো চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাস নেপালের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমেছে। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি তাদের রিজার্ভ ৫ দশমিক ৭ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩১ হাজার ৯৩২ কোটি রুপি। প্রকাশ কুমার শ্রেষ্ঠার মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস শেষে নেপালের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও কমে যাওয়ার সবধরনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার ফলে সরকারের বিদেশ থেকে পণ্য কেনার ক্ষমতা কমে যায় এবং এর কারণে বিদেশিরা বিনিয়োগে অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন।
এ অবস্থায় স্বর্ণ আমদানিতে কড়া নজরদারি শুরু করেছে নেপাল সরকার। তাদের সন্দেহ, চোরাচালানিরা প্রবাসীদের ব্যবহার করে অলঙ্কার আকারে দেশে স্বর্ণ ঢোকাচ্ছে। এতে বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে ফেরা নেপালিদের নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে স্বর্ণালঙ্কার বহনে প্ররোচিত করা হয়। আর লোভ দেখানোর এই কাজটিও করেন মূলত নেপালিরাই।
নেপালের কাস্টমস বিভাগের পরিচালক পুণ্য বিক্রম খাড়কা বলেন, আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে, স্বর্ণ চোরাচালানিরা নেপালিদের, বিশেষ করে প্রবাসী কর্মীদের বাহক হিসেবে ব্যবহার করছে। স্থানীয় বিমানবন্দরে স্বর্ণের বেশ কয়েকটি লকেট ও চুড়িসহ কয়েকজনকে গ্রেফতারের পর এই চক্রের তথ্য সামনে আসে।
গত সেপ্টেম্বরে শ্রী এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে কাঠমান্ডু থেকে নেপালগঞ্জ যাওয়ার সময় স্থানীয় পুলিশ নেপালগঞ্জ বিমানবন্দরে চার কেজি স্বর্ণসহ দুজনকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে স্বর্ণের তৈরি ছয়টি বিস্কুট, পাঁচটি লকেট, একটি নেকলেস ও একটি চুড়ি উদ্ধার করা হয়।
গত ২৮ নভেম্বর নেপালের শুল্ক বিভাগ ঘোষণা দেয়, বিদেশফেরত লোকেরা শুল্ক না দিয়ে সর্বোচ্চ ৫০ গ্রাম স্বর্ণালঙ্কার নিতে পারবেন। এর চেয়ে বেশি হলে শুল্ক পরিশোধ করে সর্বোচ্চ ২০০ গ্রাম নেওয়া যাবে। ২০০ গ্রামের বেশি স্বর্ণালঙ্কার থাকলে তা বাজেয়াপ্ত করা হবে। একইভাবে, শুল্ক পরিশোধ করে বিদেশ থেকে ১০০ গ্রাম পর্যন্ত যেকোনো ধরনের স্বর্ণ আনা যাবে বলেও ওই নোটিশে উল্লেখ করা হয়।
কাঠমান্ডু বিমানবন্দর কাস্টমস অফিসের প্রধান কর্মকর্তা মহেশ ভট্টরাই বলেন, এই নিয়ম দেড় বছর ধরে থাকলেও তা কঠোরভাগে প্রয়োগ শুরু হয়েছে কিছুদিন আগে। আমদানি বৃদ্ধি সত্ত্বেও রেমিট্যান্স কমার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের কথা বিবেচনায় এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
নেপালি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কড়াকড়ি আরোপের পর নেপালে স্বর্ণ আমদানির পরিমাণও কমে গেছে। গত ২৯ নভেম্বর ২১ কেজি স্বর্ণ জব্দের পরের দিনই ত্রিভুবন বিমানবন্দরের কাস্টমস কর্মকর্তারা ১২ কেজি এবং তৃতীয় দিন ১৬ কেজি স্বর্ণ জব্দ করেন।
কর্মকর্তাদের সন্দেহ, চোরাকারবারিরা শুল্ক এড়াতে প্রবাসী কর্মীদের ব্যবহার করে অল্প অল্প করে স্বর্ণ আনছে। নেপালে ঢোকার পর মূল্যবান ধাতুটি সংগ্রহ করে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে, বিশেষ করে ভারতে।
নেপাল রাষ্ট্র ব্যাংকের অর্থনৈতিক গবেষণা বিভাগের প্রধান বলেন, সরকারের লক্ষ্য প্রবাসীদের স্বর্ণ আনা থেকে নিরুৎসাহিত করা, যেন তাদের কষ্টার্জিত অর্থ নেপালে আসে। এই পদক্ষেপ স্বর্ণ আনার বদলে বাড়িতে অর্থ পাঠাতে উৎসাহিত করবে, যার ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে স্বর্ণ চোরাচালানি বন্ধের পাশাপাশি হুন্ডির মতো অবৈধ কৌশলে অর্থ পাঠানোও আটকাতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: