সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে লক্ষ্যমাত্রার ৪৬ ভাগ

সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে লক্ষ্যমাত্রার ৪৬ ভাগ

প্রথম নিউজ, অনলাইন: চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুতেই সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ সময় সঞ্চয়পত্র বিক্রির সঙ্গে বেড়েছে নিট বিনিয়োগের পরিমাণও। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বরে) সঞ্চয়পত্র থেকে নিট বিনিয়োগ এসেছে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। মানে সরকারই এ অর্থ ঋণ নিয়েছে। এ সময়েই সরকার এই খাত থেকে পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার ৪৬ শতাংশ ঋণ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে, ব্যাংকে আমানতের সুদহার বাড়ানোর ফলে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়ানোরও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। শুধু তাই নয়, সরকারের রাজস্ব আয়ে ঘাটতি দূর করতে এবং ব্যাংকঋণে নির্ভরতা কমাতে এখন সঞ্চয়পত্রকেই অন্যতম উপায় হিসেবে বিবেচনা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এজন্য সব ধরনের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এতে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ আরও বাড়বে বলে ধারণা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, বর্তমানে ব্যাংক খাতে চলছে টালমাটাল পরিস্থিতি। সেইসঙ্গে অনেক ব্যাংক গ্রাহকের টাকা সঠিক সময়ে ফেরত না দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। ফলে ব্যাংকের সুদহার বাড়ানোর পর অনেকে সঞ্চয়পত্রকেই নিরাপদ মনে করছেন। তাই সঞ্চয়কারীরা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। পাশাপাশি আগের কেনা সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে আবারও নতুন করে বিনিয়োগ করছেন।

জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, মূলত তিনটি কারণে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ বাড়ছে। প্রথমত, বর্তমানে ব্যাংক খাতে এক ধরনের অস্থিরতা চলছে। অনেক ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। যার ফলে গ্রাহকের আস্থাহীনতাও বাড়ছে। ফলে আমানতের সুদের হার আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেলেও মানুষ এখন আর কোনো ব্যাংকেই টাকা রাখছে না। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘদিন ধরে পুঁজিবাজারে মন্দা চলছে। ভালো হওয়ার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। তাই সবাই এখন নিরাপদ সঞ্চয়পত্রেই বেশি বিনিয়োগ করছেন। সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ বাড়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে, বর্তমানে প্রবাসীরা অনেক বেশি পরিমাণে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। তবে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ বাড়লে সরকারের সুদ পরিশোধের চাপ বাড়ে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

একই বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতির সব খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকে জীবিকার জন্য আমানত তুলে নিয়েছেন। কিন্তু উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি বাজারে আরও বেশি টাকা এনেছে, মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষকে চাপে ফেললেও কিছু মানুষ এর সুফল পেয়েছে। এর ফলে বাড়তি টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছে।

নিয়ম অনুযায়ী, আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা থাকে। সরকার তা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এ কারণে অর্থনীতির ভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রথম তিন মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ হয়েছে ৮ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত জুলাইয়ে হয়েছে ২ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা, আর আগস্টে হয়েছে ২ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে তা আরও বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্রের এই নিট বিনিয়োগই চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথম তিন মাসেই নিয়েছে ৮ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা বা লক্ষ্যমাত্রার ৪৬ শতাংশ। গত অর্থবছর সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে নিট বিনিয়োগ হয়েছে ঋণাত্মক ২১ হাজার ১২৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ পুরো অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকার এক টাকাও ঋণ নেয়নি। এ বিষয়টিকে মাথায় রেখেই ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা আরও কমানো হয়েছে। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। যদিও অর্থবছর শেষে নিট বিক্রি হয়েছিল ঋণাত্মক প্রায় ৩ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।

সঞ্চয়পত্র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অতি মাত্রায় সুদ পরিশোধ কমাতে গত দুই অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নানা শর্ত দেওয়া হয়। ফলে এ খাতে বিনিয়োগ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিতে নেমেছে। এমন পরিস্থিতিতে চলতি বাজেটে ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্রের নির্ভরতাও কমিয়ে ফেলেছে সরকার। এখন ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থাকলে রিটার্নের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ছাড়া গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব রকম সঞ্চয়পত্রের সুদহার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। তার আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা হয়। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। দুর্নীতি বা কালো টাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা বন্ধে ক্রেতার তথ্যের একটি ডাটাবেজও তৈরি করা হয়েছে। মূলত এসব কারণেই সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ অনেকাংশে কমে গেছে।

এদিকে, বর্তমান সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব নেওয়ার আগে সবসময়ই সঞ্চয়পত্রকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থার জায়গা হিসেবে বিবেচনা করে এ খাত থেকে সরকারের ঋণ কমানোর সমালোচনা করে আসছেন। তিনি অর্থ উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর আবার সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগে বেশকিছু সুবিধাও বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে মেয়াদ শেষে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের অর্থ সুদ-আসলে বিনিয়োগকারীর অ্যাকাউন্টে ফেরত দেওয়া হয়। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মেয়াদ শেষে সঞ্চয়কারীরা তাদের বিনিয়োগের অর্থ তুলে না নিলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বিনিয়োগ হয়েছে বলে বিবেচিত হবে। যার থেকে সঞ্চয়কারীরাও ওই বাড়তি বিনিয়োগের অর্থ থেকে বাড়তি সুদ-সুবিধাও পেতে থাকবেন।

এ ছাড়া সম্প্রতি গ্রাহকের ভোগান্তি কমাতে সঞ্চয়পত্রের বিষয়ে নতুন এক নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে বলা হয়েছে, সঞ্চয়পত্রের মেয়াদপূর্তির দিনেই গ্রাহককে আসলসহ মুনাফার টাকা ফেরত দিতে হবে। জানা গেছে, এতদিন সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর আসল টাকা তুলতে সময়ক্ষেপণসহ নানা ভোগান্তির শিকার হতেন গ্রাহক। নতুন এ নির্দেশনার ফলে এই ভোগান্তি দূর হলো। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশি মেরিনার, পাইলট ও কেবিন ক্রুরা এতদিন ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ পেতেন না, এখন তাদেরও এই বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এভাবে ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড, ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডসহ সঞ্চয় অধিদপ্তর পরিচালিত ১১টি সঞ্চয় স্কিমের বিনিয়োগগুলো মেয়াদ শেষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বিনিয়োগের সুযোগও তৈরি হয়েছে।

বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে। পাঁচ বছরমেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ৫২, পাঁচ বছরমেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ৭৬, পাঁচ বছরমেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ২৮, তিন বছরমেয়াদি ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। কয়েক দফায় সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো হলেও এখনো তা ব্যাংকের তুলনায় বেশি।