Ad0111

সিঙ্গেল তোষক ৩৩০০ টাকা!

যশোর কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের আসবাবপত্র কেনার জন্য সরকারি বরাদ্দের ১৭ লাখ ৭৬ হাজার টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে।

সিঙ্গেল তোষক ৩৩০০ টাকা!
সিঙ্গেল তোষক ৩৩০০ টাকা!

প্রথম নিউজ, যশোর: যশোর কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের আসবাবপত্র কেনার জন্য সরকারি বরাদ্দের ১৭ লাখ ৭৬ হাজার টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে। সরকারি বরাদ্দের এই টাকা নয়ছয় করার অভিযোগ উঠেছে যশোরের সাবেক মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সখিনা বেগমের বিরুদ্ধে। তিনি একটি সিঙ্গেল তোষকের ক্রয় মূল্য দেখিয়েছেন ৩ হাজার ৩শ’ টাকা। যা যশোরের স্থানীয় বাজারে সর্বোচ্চ ৩শ’ টাকা মূল্যে বিক্রি হচ্ছে হরহামেশা। এছাড়া টিভি, ফ্রিজ, খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, ডাইনিং টেবিল, স্টিলের ফাইল কেবিনেট, পড়ার টেবিল, কম্পিউটার ও কম্পিউটার টেবিল, ফটোকপিয়ার মেশিন, স্ক্যানার মেশিন, ফ্যাক্স মেশিনসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র ক্রয়ে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, যশোর সরকারি কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে আসবাবপত্র ক্রয় করার জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ১৭ লাখ ৭৬ হাজার টাকার বরাদ্দ দেয়। এই বরাদ্দ আসে যশোর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে।খোঁজখবরে জানা গেছে, সরকারি বরাদ্দের টাকায় মালামাল ক্রয়ের জন্য কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের একটি ক্রয় কমিটি আছে। কিন্তু এই ক্রয় কমিটিকে বাইপাস করে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের প্যাডে কোটেশনের মাধ্যমে মালামাল ক্রয় করেছেন সাবেক এই উপ-পরিচালক। যশোর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক সোখিনা বেগম ২০টি সিঙ্গেল তোষকের ক্রয় মূল্য দেখান ৬৬ হাজার টাকা।

যার প্রতিটির মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৩ হাজার ৩০০ টাকা। ২৬টি সিঙ্গেল চৌকি-খাট ক্রয় করা হয়েছে। যার মোট মূল্য দেখানো হয়েছে ৩ লাখ ৩২ হাজার ৮০০ টাকা। প্রতিটি সিঙ্গেল চৌকি-খাটের মূল্য দেখানো হয়েছে ১২ হাজার ৮০০ টাকা। অথচ প্রতিটি খাটের স্থানীয় বাজার মূল্য ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা। দু’টি ছোট স্টিল আলমারির মূল্য ধরা হয়েছে ৪৭ হাজার টাকা। অথচ স্থানীয় বাজারে এ আলমারি দু’টির দাম ১৪ হাজার টাকার বেশি না। একটি ছোট স্টিল ফাইল কেবিনেট (৪ ড্রয়ারের) দাম দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৯৫০ টাকা। এ ধরনের স্টিল ফাইল ক্যাবিনেটের যশোরে বাজার মূল্য সর্বোচ্চ ৬ হাজার টাকা। ২ লাখ ৪ হাজার টাকায় কেনা হয়েছে ১২টি ড্রেসিং টেবিল। যার প্রতিটির ক্রয় মূল্য পড়েছে ১৭ হাজার টাকা। যশোরের বাজারে এ ধরনের ড্রেসিং টেবিলের দাম সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকার মধ্যে। দু’টি ডাইনিং টেবিলের ক্রয় মূল্য দেখানো হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। যার প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছে ২৫ হাজার টাকা করে। স্থানীয় বাজারে এ ধরনের ডাইনিং টেবিলের দাম ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার মধ্যে। হাতলযুক্ত সাধারণ একটি সোফা সেটের মূল্য দেখানো হয়েছে ৩৫ হাজার পাঁচশ’ টাকা। যার প্রকৃত বাজার মূল্য ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। ৬৪টি পণ্যের মূল্য দেখানো হয়েছে ৭ লাখ ৭০ হাজার ২৫০ টাকা। ৭ শতাংশ ভ্যাটসহ দাম দেখানো হয়েছে ৮ লাখ ২৪ হাজার ১৬৭ টাকা।

একটি ৫৬ সিএফটি সার্ফ ডিপ ফ্রিজের মূল্য দেখানো হয়েছে এক লাখ টাকা, প্রকৃতপক্ষে এটির বাজার মূল্য ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। একটি ফটোকপিয়ার মেশিনের দাম দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, যার প্রকৃত বাজার মূল্য ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা, একটি চায়না নন ব্র্যান্ডের ৫৬ ইঞ্চি টেলিভিশনের দাম ধরা হয়েছে এক লাখ টাকা। যার প্রকৃত বাজার মূল্য ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা। একটি ডেক্সটপ কম্পিউটারের মূল্য দেখানো হয়েছে ৮০ হাজার টাকা, যার প্রকৃত বাজার মূল্য ২৫ থেকে ২৮ হাজার টাকা। একটি ক্যানন ব্র্যান্ডের প্রিন্টারের দাম ধরা হয়েছে ২৫ হাজার টাকা, যার বাজার মূল্য ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। একটি স্ক্যানার মেশিনের মূল্য ধরা হয়েছে ১০ হাজার টাকা, যার কোনো অস্তিত্ব নেই। একটি ফ্যাক্স মেশিনের মূল্য দেখানো হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু অফিসে গিয়ে কোনো ফ্যাক্স মেশিন পাওয়া যায়নি। এই ৭টি পণ্যের মোট দাম ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। যা বর্তমান বাজার মূল্যের দ্বিগুণেরও বেশি।

এছাড়া অবশিষ্ট ৪ লাখ ৭১ হাজার ৮৩৩ টাকায় ক্রয় দেখানো হয়েছে ১২টি স্টিলের আলনা, একটি কম্পিউটার টেবিল, একটি চেয়ার, হাতলযুক্ত ১০টি গদিওয়ালা চেয়ার, দু’টি জুনিয়র এক্সিকিউটিভ টেবিল, একটি এক্সিকিউটিভ টেবিল, একটি মিটসেফ, হাতলযুক্ত কাঠের চেয়ার তিনটি, রিডিং টেবিল ৩৬টি ও ২৬টি সাধারণ চেয়ার।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সোখিনা বেগম যশোর মহিলা অধিদপ্তরে দায়িত্ব থাকাকালীন বিভিন্ন সময় মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ দেয়া টাকা-পয়সা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তসরুফ করেছেন। এরমধ্যে যশোরে কিশোর ক্লাবে জন্য দেয়া টিফিনের টাকা ও বিভিন্ন অনুদানের টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নারীদের মাতৃত্বকালীন অনুদানের টাকাও এ কর্মকর্তা আত্মসাৎ করেছেন বলে একাধিক নারী অভিযোগ করেছেন। আত্মসাৎ করা এই বিপুল পরিমাণ টাকা দিয়ে তিনি যশোর মেডিকেল কলেজের সামনে মেইন রোডের পাশে (শঙ্করপুর মৌজায়) নুরুদ্দিন নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৮ শতক জমি ক্রয় করেছেন। ওই জমির উপরে ৫ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে তিনি তিনতলার আলিশান বাড়ি তৈরি করেছেন। বর্তমানে চতুর্থ তলার নির্মাণ কাজ চলমান। প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য এই বাড়ি তৈরির টাকা তিনি কোথায় পেলেন তা নিয়ে রয়েছে নানা গুঞ্জন। এলাকাবাসী বলছেন, সোখিনা বেগমের স্বামীও কিছুই করেন না, সারাদিন ঘরের ভেতরে আবদ্ধ থাকেন।
তার এক প্রতিবেশী জানান, একটা মানুষ চাকরি করে শহরে ভাড়া বাড়ি থেকে ৫-৬ বছরে কত টাকা জমাতে পারে যে, তিন বছরের মধ্যে কোটি টাকার জমি ক্রয় করে আবার সেই জমির ওপরে ২ কোটি টাকার বেশি খরচ করে বাড়ি তৈরি করা যায়।

যশোর কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের অফিস সহকারী নাসরিন আক্তার মালার কাছে এই মালামাল ক্রয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যশোরে কর্মজীবী মহিলাদের আবাসন সুবিধার্থে শহরের ভোলা ট্যাংক রোডে এই হোস্টেলটি অবস্থিত। এই হোস্টেলে মালামাল কেনাকাটার জন্য সরকার বিপুল পরিমাণে টাকা বরাদ্দ দিয়েছে বলে শুনেছি। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সোখিনা বেগম সরকারের নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা না করে নামসর্বস্ব মালামাল ক্রয় করে হোস্টেলে সরবরাহ করেছেন। তিনি জানান, আসবাবপত্র ক্রয়ের জন্য একটি কমিটি থাকলেও সোখিনা বেগম কমিটির কারোর কোনো মূল্যায়ন না করে নিজের ইচ্ছামতো নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের প্যাডে বিল-ভাউচার করে মালামালগুলো সরবরাহ করেছেন। মালামালগুলো গ্রহণ করা হয়েছে মর্মে তিনি হোস্টেল সুপারের কাছ থেকে অনেকটা জোর করে লিখিত নিয়েছেন বলে দাবি করেন নাসরিন আক্তার মালা।

তিনি বলেন, এসব পণ্যের ভুতুড়ে বিল-ভাউচার দেখে তিনি নিজেই অবাক হয়েছেন। জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের সাবেক ডিডি নিম্নমানের কিছু মালামাল দিয়ে উচ্চ মূল্য নির্ধারণ করেছেন বলেও তিনি দাবি করেন। বিষয়টি তিনি বর্তমানে দায়িত্বে থাকা উপ-পরিচালক আনিসুর রহমানকেও জানিয়েছেন। বর্তমান ডিডি ইতিমধ্যে হোস্টেল পরিদর্শন করেছেন এবং বিষয়টি সম্পর্কে আর অধিক খোঁজখবর নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবেন বলে জানিয়েছেন।

বিষয়টি নিয়ে যশোর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক সোখিনা বেগমের মুঠোফোনে যোগাযোগ করে এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ফোন রিসিভ করে ব্যস্ততার অজুহাতে কেটে দেন।
বিষয়টি নিয়ে যশোর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের বর্তমানে দায়িত্ব্বে থাকা উপ-পরিচালক আনিসুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এখানে এসেছি দুই মাস হলো। আসার পর পর বিষয়টি জেনেছি। সাবেক মহিলা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সোখিনা বেগমকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। তিনি লিখিতভাবে জানিয়েছেন, কেনাকাটার বিষয়টি বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে। তাই আমার সব মনে নেই। সোখিনা ম্যাডামের এ ধরনের বক্তব্য আমি নোট করেছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি লিখিতভাবে জানানো হবে বলে তিনি জানান।

বিষয়টি নিয়ে মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মনোয়ারা ইশরাতের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যশোর কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন মালামাল কেনাকাটার জন্য টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল গত অর্থ বছরে। সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় বিল-ভাউচার দাখিল করেছেন। কিন্তু কেনাকাটায় অনিয়ম হয়েছে কি-না সেটা আমার জানা নেই। তাছাড়া কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের বিষয়টি দেখাশোনা করে থাকেন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব (অতিরিক্ত পরিচালক) মুসলিমা খাতুন মুন।

মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব (অতিরিক্ত পরিচালক) মুসলিমা খাতুন মুন বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযোগ আমার জানা নেই। তবে অভিযোগ পেলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হবে। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom

 

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

This site uses cookies. By continuing to browse the site you are agreeing to our use of cookies & privacy Policy from www.prothom.news