শুল্ক-ভ্যাটের হার বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়াতে পারবেন না
প্রথম নিউজ, ঢাকা : সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাটের হার বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব নয়। রাজস্ব আয় বাড়াতে হলে রাজস্বের আওতা বাড়তে হবে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়তে হবে। আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর জন্য বাণিজ্যনীতি আরও উদার করতে হবে বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জাইদি সাত্তার।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে সম্প্রতি রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং বাজেট ঘাটতি কমাতে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। বিষয়টি নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন এই অর্থনীতিবিদ। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সাঈদ শিপন।
জাগো নিউজ: সম্প্রতি বিভিন্ন পণ্যের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এভাবে ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোকে কীভাবে দেখছেন?
ড. জাইদি সাত্তার: সম্পূরক শুল্ক হলো ট্রেড নিউট্রাল ট্যাক্স। মানে আমদানির ওপর যা বসবে, ডমেস্টিক প্রোডাক্টের (স্থানীয় পণ্য) ওপরও একই হারে বসবে। কিন্তু আমাদের শতকরা ৯০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আমদানির ওপর যা বসছে, সেটা ডমেস্টিকের ওপর হয়নি, না হয় কম আছে। এগুলো ঠিক নয়। আমি মনে করি সম্পূরক শুল্ক আমদানি ও ডমেস্টিক পণ্যের ওপর সমান হওয়া উচিত।
সম্পূরক শুল্ক এভাবে থাকা উচিত নয়। সম্পূরক শুল্ক ভ্যাট আইনের আওতায় আছে। ভ্যাট আইনের আওতায় থাকলে সম্পূরক শুল্ক আমদানি ও স্থানীয় পণ্যের ওপর সমান সমান হওয়া উচিত। এত বছর ধরে সম্পূরক শুল্ককে প্রটেকশন উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন আরও।
আমদানির ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়া হলো, এটা তো প্রটেকশনের জন্য। তো প্রটেকশন হলে আপনি রেভিনিউ (রাজস্ব) পাবেন কীভাবে? প্রটেকশন মানে আপনি সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে আমদানি কমাচ্ছেন।
জাগো নিউজ: সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানো কি সম্ভব?
ড. জাইদি সাত্তার: আমদানির ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়া হলো, এটা তো প্রটেকশনের জন্য। তো প্রটেকশন হলে আপনি রেভিনিউ (রাজস্ব) পাবেন কীভাবে? প্রটেকশন মানে আপনি সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে আমদানি কমাচ্ছেন। তাহলে আপনি রাজস্ব পাবেন কীভাবে? সুতরাং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছেন, রেভিনিউ পাবেন না। ৯০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক সংরক্ষণ নীতির উপদান। তাহলে প্রটেকশন পাচ্ছেন, কিন্তু রেভিনিউ তো পাচ্ছেন না।
ড. জাইদি সাত্তার: রাজস্ব আয় বাড়াতে গেলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কীভাবে বাড়ায়? বাণিজ্য কর বাড়িয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ে না। আমাদের নব্বই দশকের অভিজ্ঞতা আছে। আমরা যখন উদার বাণিজ্যনীতি ফলো করেছি, আমাদের অর্থনীতির পরিধি অনেক বেড়ে গেছে। তাতে রেভিনিউও অনেক বেড়েছে। রেভিনিউ লস কখনো হয়নি। গোটা নব্বই দশকে এত শুল্ক কমানো হলো, কোনো দিন রেভিনিউ লস হয়নি।
রাজস্ব আয় বাড়াতে গেলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কীভাবে বাড়ায়? বাণিজ্য কর বাড়িয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ে না।
সুতরাং আপনি যদি রেভিনিউ বাড়াতে চান, শুল্ক ও ভ্যাটের রেট বাড়িয়ে রেভিনিউ বাড়াতে পারবেন না। রেভিনিউ বাড়বে যদি, রেভিনিউর বেজটা আপনি বাড়ান। আওতায় আরও বেশি আনেন এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যদি বাড়ে তাহলে রেভিনিউ বাড়বে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর জন্য বাণিজ্যনীতি আরও উদার করতে হবে।
বাংলাদেশে আমাদের অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু আমরা সেই অভিজ্ঞতা কোনো কাজে ব্যবহার করতে চাচ্ছি না। আমরা অন্যদিকে চলে যাই। রেট বাড়িয়ে রেভিনিউ বাড়ানোর স্ট্রাটেজি (কৌশল) আমরা সমর্থন করি না। রেট বাড়িয়ে রেভিনিউ বাড়ানো এটা কখনো হয় না। সম্পূরক শুল্কের ক্ষেত্রে আমি পরিষ্কার বলে দিতে চাই রেট বাড়ানো মানে প্রটেকশন বাড়ানো, প্রটেকশন বাড়ানো মানে রেভিনিউ কমানো।
জাগো নিউজ: মূল্যস্ফীতি কমানো এখন বড় একটি অগ্রাধিকার। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দেওয়া হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন পণ্যের শুল্ক, ভ্যাট বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?
ড. জাইদি সাত্তার: ২০২২ সালের মে মাস থেকে এ পর্যন্ত টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেছে ৪০ শতাংশ। যেখানে ১ ডলার ৮৫ টাকা ছিল, সেখানে ১ ডলার এখন ১২২ টাকা ব্যাংক রেট। খোলাবাজারে তো ১২৬ টাকার মতো আছে। এখানে প্রায় ৪০ শতাংশ অবমূল্যায়ন। ৪০ শতাংশ অবমূল্যায়ন মানে কী? এক হচ্ছে- সব আমদানির যে ভ্যালু (মূল্য), সেই ভ্যালু ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ১০০ টাকার যদি আমদানি হয়, এটা ১৪০ টাকা হয়ে গেছে।
শুল্ক বেড়েছে কোনো একটা পণ্যের ওপর নয়, কোনো একটা পণ্যের আমদানি মূল্য বাড়েনি, বেড়েছে সব আমিদানি মূল্য। এখানে ক্যাপিটাল গুডস আছে, কনজ্যুমার গুডস আছে, কাঁচামাল আছে। সবগুলোর দাম বেড়ে গেলো। মূল্যস্ফীতি বাড়বে না কেন?
তাহলে যতগুলো শুল্ক আছে, যদি শুল্ক ১০ শতাংশ থাকে, এই ১০ শতাংশ শুল্ক এখন ৪০ শতাংশ বেড়ে গেলে ১৪ টাকা হয়ে যাবে। ১০০ টাকায় ১০ টাকা শুল্ক হলে, এখন ১০০ টাকায় ১৪ টাকা শুল্ক। আপনি অবমূল্যায়ন করে শুল্কগুলো বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাহলে শুল্কগুলো কমান না কেন? ওনারা বলবেন রেভিনিউ লস হবে। আরে আপনি তো শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছেন ৪০ শতাংশ বা বেড়ে গেছে। এখন তো আর রেভিনিউ আরগুমেন্ট করতে পারবেন না।
শুল্ক বেড়েছে কোনো একটা পণ্যের ওপর নয়, কোনো একটা পণ্যের আমদানি মূল্য বাড়েনি, বেড়েছে সব আমিদানি মূল্য। এখানে ক্যাপিটাল গুডস আছে, কনজ্যুমার গুডস আছে, কাঁচামাল আছে। সবগুলোর দাম বেড়ে গেলো। মূল্যস্ফীতি বাড়বে না কেন? কিন্তু এই জায়গায় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলো না। এই যে শুল্ক ৪০ শতাংশ বেড়ে গেলো, আমরা এটাকে ২০ বা ৩০ শতাংশে আনতে পারি না? এখন তো রেভিনিউ আরগুমেন্ট করতে পারবে না।