শ্রীপুরে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ২৩টি ঘরের মধ্যে ১৬টিই খালি

শ্রীপুরে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ২৩টি ঘরের মধ্যে ১৬টিই খালি

প্রথম নিউজ, গাজীপুর : গাজীপুরের শ্রীপুরে মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের সাইটালিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের বেশির ভাগ ঘরেই তালা ঝুলছে। এসব ঘরে থাকছেন না বরাদ্দপ্রাপ্তরা। নীতিমালা আনুযায়ী প্রকৃত সুবিধাভোগী বাছাই করতে না পারা, বরাদ্দের সময় স্বজনপ্রীতি, প্রভাবশালী নির্দেশনায় প্রকৃত আশ্রয়হীনদের মধ্যে ঘর বিতরণ না করায় ঘরগুলো ব্যবহার করছে না। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রকৃত আশ্রয়হীনরা।

বুধবার (২৬ই জুলাই) উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের সাইটালিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর অধিন ২০২১-২০২২ অর্থবছরে এসব ঘর তৈরি করা হয়। প্রশাসনের কঠোর নজরদারির কারণে কাজের মান নিশ্চিত হলেও উপজেলা টাস্কফোর্স কমিটি সুবিধাভোগী বাছাইয়ে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। চলতি বছরের শুরু থেকে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরের ২৩টি পরিবারের মাঝে পাকা বসত বাড়ি বরাদ্দ দেয় সরকার। এ ২৩টি বাড়ির মধ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস করে মাত্র ৭টি পরিবার।

তারা জানান, প্রকৃত ভূমিহীনদের মধ্যে ঘর বিতরণ করা হয়নি, যারা পাওয়ার যোগ্য তাদের ঘর দেওয়া হয়নি। ঘরের প্রয়োজন নেই তাই তারা এখানে থাকেন না মাঝে মধ্যে আসেন।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সাইটালিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে ২৩টি পরিবারের মাঝে পাকা ঘর বরাদ্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭টি পরিবার বরাদ্দের পর থেকে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। এদের বাইরে তিনটি ঘরে কেউই স্থায়ী না থাকলেও মাঝে মধ্যে এসে ঘর পরিষ্কার করে তারা চলে যান। এ প্রকল্পের এমনও বরাদ্দকৃত ঘর আছে যারা উদ্বোধনের পর ঘর তালাবন্ধ করে চলে গেছেন আর কখনও আসেননি। এজন্যই বেশির ভাগ ঘর ফাঁকা পড়ে আছে। এসব ঘরের বারান্দায় খড়কুটো রাখা রয়েছে। সামনে লাগানো বিভিন্ন ধরনের শাক সবজি ও লতাপাতা ঘরের বারান্দা পর্যন্ত গিয়ে উঠেছে।

সাইটালিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে পাকা বাড়ি বরাদ্দ পেয়েছেন কুলছুম বেগম। ঝালমুড়ি বিক্রেতা স্বামীকে নিয়ে বিভিন্নজনের বাড়িতে বসবাস করতেন তিনি। সরকারের এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, আমি সত্যিই অসহায় ছিলাম। ঘর পাওয়ার পর আমরা নতুন করে জীবন পেয়েছি। এখানে যারা থাকে অসহায়, তাদের ঘর-বাড়ি নাই। কিন্তু অনেকেই ঘর বরাদ্দ পাওয়ার পর এখানে থাকেন না। এখানে ২৩টি পরিবারের মধ্যে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হলেও থাকেন ৭টি পরিবার। বাকিরা মাসে একবার কখনও, কখনও আবার আসে না।

অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ২১নং ঘরে থাকেন ফিরোজা। তিনি বলেন, বরাদ্দপ্রাপ্ত অনেকেই ঘর তালাবদ্ধ করে রেখে গেছেন। ২২নম্বর ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন হাফিজ উদ্দিন। তিনি মাঝে মধ্যে বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসেন। ঘরে বসে খিচুড়ি রান্নাসহ নানা ধরনের খাবার আয়োজন করে চলে যান। ৫নং ঘর বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তি এখনও একবারের জন্যও আসেননি। তার সঙ্গে আমাদের কোনো পরিচয় নেই। তাদের হয়তো ঘরের কোনো প্রয়োজন নেই। তবুও মেম্বার-চেয়ারম্যান কেন তাদের ঘর বরাদ্দ দিল, এমন প্রশ্ন তারও।

কুলছুম-ফিরোজার সঙ্গে কথা বলার সময় আসেন রতন নামের আরেক যুবক। তিনিও এই আশ্রয়ণের বাসিন্দা। তিনি বলেন, যাদের প্রয়োজন তারা ঘর পায়নি। যাদের প্রয়োজন নেই তারা ঘর পেয়েছেন। ঘর বরাদ্দ পাওয়া অনেকেরই বাড়ি আছে। বাড়ি না থাকায় অনেকেই বনে জমিতে, বিভিন্নজনের বাড়িতে থাকছেন। ঘর দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রকৃত ভূমিহীন যাচাই বাছাই করা হয়নি।

জন্ম থেকেই খুঁড়িয়ে চলেন প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক নুরুল আলম। জাতীয় পরিচয়পত্রে কেওয়া পশ্চিম খন্ড তার ঠিকানা দেখালেও প্রকৃতপক্ষে তার কোনো আশ্রয় নেই। সাত বছর বয়সী একমাত্র ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। সারাদিন মানুষের কাছে হাত পেতে যা পান তাতে বাসা ভাড়া দিতেই চলে যায়।

নুরুল আলম জানান, প্রধামন্ত্রীর ঘর দেবে এমন খবর শুনে তিনি জেলা প্রশাসক, ইউএনও, এসিল্যান্ড, স্থানীয় নেতাকর্মী সবার কাছেই আবেদন দিয়েছেন। তবুও উপহারের ঘর তিনি পাননি। এখন যখন দেখছেন অনেকেই ঘর পেয়েও থাকেন না, এটা দেখে তার কষ্ট বেড়েছে।

আশ্রয়হীন প্রতিবন্ধী হেলাল উদ্দিন স্থানীয় সংসদ সদস্যের সুপারিশ নিয়েও ঘর পাননি। একটি ঘরের জন্য ঘুরেছেন প্রশাসনসহ বিভিন্ন জনের কাছে। তবুও মেলেনি ঘর। 

তিনি বলেন, একটি ঘরের জন্য একটু আশ্রয়ের জন্য কতজনের কাছে যে গিয়েছিলাম, কতজনের দ্বারে দ্বারে যে ঘুরেছি, কিন্তু কারও মন গলাতে পারিনি। যাদের ঘর দিয়েছে তারা নাকি থাকেন না, আর আমি ভাড়ায় থাকি। আমাদের দাবি, প্রকৃত আশ্রয়হীন বাছাই করে পুনরায় ঘরগুলো বরাদ্দ দেওয়া হোক।

এ বিষয়ে তেলিহাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল বাতেন সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘর বরাদ্দ পাওয়া লোকজন কেন সেখানে থাকছেন না তা আমরা জানি না। তবে আমাদের ইউএনও মহোদয় প্রশিক্ষণজনিত ছুটিতে আছেন, তিনি এলে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো।

শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম প্রশিক্ষণজনিত ছুটিতে থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ইউএনও’র দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আল মামুন বলেন, এ বিষয়ে ইউএনও স্যার বক্তব্য দেবেন। আমার কিছু বলার নেই।

সদ্য যোগদানকৃত গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম জানান, তিনি সদ্য যোগদান করেছেন। পরিদর্শন করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।