রেয়াতি সুবিধা ও মিথ্যা ঘোষণায় ভিসতার রাজস্ব ফাঁকি

রেয়াতি সুবিধা ও মিথ্যা ঘোষণায় ভিসতার রাজস্ব ফাঁকি

প্রথম নিউজ, ঢাকা : রেয়াতি সুবিধার অপব্যবহার এবং ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য আমদানি করে সোয়া কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে ইলেকট্রনিকস পণ্য আমদানি, উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভিসতা ইলেকট্রনিকস লিমিটেড।

সাত চালানে বিভিন্ন কৌশলে এটি উদঘাটিত হয়েছে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত দাবিনামা ইস্যু করা হলেও ফাঁকিকৃত টাকা এখনো সরকারি কোষাগারে জমা হয়নি বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ও কাস্টমস গোয়েন্দার একাধিক কর্মকর্তা রোববার ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি রেয়াতি সুবিধার অপব্যবহার করেছে। শুল্কায়নের সময় করে কাগজপত্র যাচাই না করেই পণ্য খালাস দিয়েছে। যে এসআরওতে রেয়াতি সুবিধা দাবি করা হয়েছে— সেই এসআরও এই প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য নয়। প্রথম দফায় দুইটি চালানের বিপরীতে প্রভাব খাটিয়ে পণ্য খালাস নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর শুল্ককর, জরিমানা ও অর্থদণ্ড পরিশোধ করে পণ্য খালাস করে। সন্দেহ তৈরি হলে পেছনের নথিপত্র ঘেটেও ফাঁকির বিষয়টি উদঘাটিত হয়েছে। সে বিষয়ে দাবিনামা জারি করা হয়েছে কিন্তু রাজস্ব জমা হয়নি।

এর আগে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে খালাস পর্যায়ে ২০২৩ সালের মার্চে দুইটি চালান আটক করে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। আটকের পরপর অভিযোগের প্রমাণও মিলে যায়। এনবিআরের নির্দেশনায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে রেয়াতি সুবিধার অপব্যবহার ও ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য আমদানির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিচারাদেশে অর্থদণ্ড ও জরিমানা করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। শুধু তাই নয় রেয়াতি সুবিধার অপব্যবহারে সহায়তা করা অর্থাৎ শুল্কায়নের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের শাস্তির সুপারিশও করা হয়।

এ বিষয়ে এনবিআর সূত্রে জানা যায়, কাস্টমস গোয়েন্দার চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে ২০২৩ সালের ১৮ জুলাই চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনারকে পৃথক দুইটি চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠির সূত্রে জানা যায়, ভিসতা ইলেকট্রনিকসের দুইটি বিল অব এন্ট্রিতে আমদানি করা পণ্য চালান শুল্কায়ন পরবর্তী খালাস পর্যায়ে আটক করা হয়। যাতে একটি চালানে পণ্যের মধ্যে ছিল— ৩২ ইঞ্চি টু-কে এইচডি এলইডি ডিসপ্লে প্যানেল ও ৪৩ ইঞ্চি ফোর-কে এইচডি এলইডি ডিসপ্লে প্যানেল। তবে প্রতিষ্ঠানের ঘোষণার চেয়ে বেশ কিছু পাওয়া যায়, যার ওজন ৩৯৩ দশমিক ৮৮ কেজি, যা মোট পণ্য অপেক্ষা ১৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি।

অপর চালানে একই পণ্য এবং ঘোষণার অতিরিক্ত ৫৩৯ দশমিক ৮৪ কেজি বেশি পণ্য পাওয়া যায়, যা মোট পণ্য অপেক্ষা ১৯ দশমিক ১৭ শতাংশ বেশি। দুই চালান শুল্কায়ন করে খালাস নেওয়ার সময় রেয়াতি সুবিধার অপব্যবহার ও ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য রয়েছে— এমন গোপন সংবাদ থাকায় কাস্টমস গোয়েন্দা চালান দুইটি লক করে। প্রতিষ্ঠানটি সিপিসি এন ১২ সুবিধায় শূন্য শতাংশ কাস্টম ডিউটি দিয়ে শুল্কায়ন করেছে। কিন্তু চালানটি এসআরও-২১৪ (১.৭.২০১৫) এর আওতায় সিপিসি সুবিধা পাওয়ার যোগ্য ছিল না।

সূত্রানুসারে, দুইটি চালান কীভাবে কাস্টমস কর্মকর্তারা রেয়াতি সুবিধায় খালাস দিয়েছে— সে সব কাস্টমস কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চিঠিতে অনুরোধ করা হয়। একই সঙ্গে দুইটি চালানে রেয়াতি সুবিধার অপব্যবহার ও অতিরিক্ত ঘোষিত পণ্য আমদানি করায় ব্যবস্থা নিতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনারকে অনুরোধ করা হয়। পরবর্তীতে কমিশনার দুইটি চালানের বিচারাদেশ দেয়। যেখানে একটি চালানে ২৭ লাখ ৯২ হাজার ২৪১ টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়, রেয়াতি সুবিধার অপব্যবহার করায় ৬০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড, ৫ লাখ টাকা জরিমানাসহ ১ কোটি ৮ লাখ ৬ হাজার ১০৪ টাকা রাজস্ব আদায়ে বিচারাদেশ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানকে এই টাকা পরিশোধ করে পণ্য খালাস নেয় বলে জানা গেছে।

অপর চালানে একইভাবে রেয়াতি সুবিধার অপব্যবহার প্রমাণিত হওয়ায় অর্থদণ্ড ও জরিমানা আরোপ করে বিচারাদেশ দেওয়া হয়। যাতে রাজস্ব ফাঁকি ৪২ লাখ ৬ হাজার ৩৪৫ টাকা, ৮৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড ও ৫ লাখ টাকা বিমোচন জরিমানা আরোপ করা হয়। বিচারাদেশ শেষে সঙ্গে সঙ্গে অনিয়ম স্বীকার করে রাজস্ব পরিশোধ করে প্রতিষ্ঠান চালানটি খালাস নিয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানকে অর্থদণ্ড ও জরিমানা করা হলেও শুল্কায়নের সঙ্গে জড়িত অর্থাৎ রাজস্ব ফাঁকিতে সহায়তা করা কোনো কর্মকর্তাকে শাস্তি দেয়নি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। এমনকি কাস্টমস গোয়েন্দাকে কোনো বিষয়ে জানানো হয়নি বলে জানা গেছে।

ওই দুইটি চালানে রেয়াতি সুবিধার অপব্যবহার পাওয়ায় পূর্বে একই কৌশলে আমদানি করা সাতটি চালানের পোস্ট ক্লিয়ারেন্স অডিট (পিসিএ) করে ফাঁকির বিষয়ে কাস্টম হাউসকে চিঠি দেয় কাস্টমস গোয়েন্দা। পরে কাস্টম হাউস পিসিএ করা হলে সাতটি চালানে অনিয়ম বেরিয়ে আসে। সাতটি চালানে একই কৌশলে প্রায় এক কোটি ১১ লাখ টাকা রাজস্ব অনিয়ম পাওয়া যায়। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানকে পৃথক সাতটি দাবিনামা জারি করা হয়।

সর্বশেষ ২০২৪ সালের নভেম্বরের শেষে চূড়ান্ত তাগাদাপত্র দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানকে সাতদিনের সময় দেওয়া হলেও প্রতিষ্ঠান এখনো কোনো রাজস্ব পরিশোধ করেনি। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রাজস্ব পরিশোধ না করলে কাস্টমস আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২০২ ধারা অর্থাৎ ব্যাংক হিসাব জব্দসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এখনো কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করেনি কাস্টম হাউস।

এ বিষয়ে ভিসতা ইলেকট্রনিকস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান হোসেন আকাশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।