রংপুরে পুলিশের গুলিতে শিক্ষার্থী নিহত আহত শতাধিক
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে আবু সাঈদ (২৫) নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন।
প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: রংপুরে পুলিশের সঙ্গে কোটা বিরোধী শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে আবু সাঈদ (২৫) নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। পরে পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের মঙ্গলবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। পুলিশ টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে। এ ঘটনায় সাংবাদিক, পুলিশসহ শতাধিক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আহত হন। আহতদের রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা যোগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের তালা ভেঙে প্রবেশ করে বিক্ষোভ করে।
শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পুলিশ উপাচার্যের বাসভবনে অবস্থান নেয়।
বেলা সাড়ে ১২টার দিকে রংপুর জিলা স্কুল প্রাঙ্গণ থেকে রংপুর জিলা স্কুল, কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রংপুর ক্যান্টঃ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবি এবং শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে মিছিল বের করে। নগরীর পুলিশ লাইন্স মোড়ে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। শিক্ষার্থীরা সেই বাধা উপেক্ষা করে সিটি করপোরেশন, পায়রা চত্বর, জাহাজ কোম্পানি মোড় হয়ে প্রেস ক্লাবে এসে অবস্থান নেয়। এ সময় ‘লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে, জেগেছে রে জেগেছে ছাত্র সমাজ জেগেছে, একদফা এক দাবি, কোটা নট কাম ব্যাক’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
পরে তারা মিছিল নিয়ে শাপলা চত্বর হয়ে বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ের দিকে যেতে থাকে। এদিকে একই সময় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে কোটা পদ্ধতি সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা লাঠিসোঁটা, জাতীয় পতাকা হাতে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মিছিল নগরীর চারতলা মোড় এলাকায় আসলে বিপরীত দিক থেকে বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মিছিল এসে যোগ দেয়। এতে কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর স্লোগানে মুখরিত মিছিল বিশ^বিদ্যালয়ের দিকে যেতে থাকে।
বিশ^বিদ্যালয় গেটের সামনে এসে অবস্থান নিতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। এরপর তারা মডার্ন মোড়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে পেছনে মিছিলের মাঝামাঝি থাকা কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে পুলিশের তর্ক হয়। এতে করে আন্দোলনকারীরা সামনে না গিয়ে আবার বিশ^বিদ্যালয়ের গেটের সামনে ফেরত এসে বিক্ষোভ করে। ভেতরে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি টের পেয়ে আন্দোলনকারীরা বিশ^বিদ্যালয়ের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা চালায়। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতে বাংলাভিশনের ক্যামেরাম্যান শাহনেওয়াজ জনি, এটিএন নিউজের শাহরিয়ার মীম, অনলাইনের সাংবাদিক আইনুল ইসলাম, সময় টিভির ক্যামেরাপারসন তরিকুল ইসলাম, কয়েকজন পুলিশ সদস্য, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীসহ শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।
এ ঘটনায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী মনসুর (২৪), সাঈদ (২৪), সাব্বির (২৪), সিয়াম (২৩), তুহিন (২৫), হাসান (২৫), সোহেল রানা (২২), নাইমুল (২৮), সোহান (২৩) সহ প্রায় ২০ জন শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবু সাঈদ মারা যান। এদিকে পুলিশ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দিলে তাদের একটি গ্রুপ মডার্ন মোড়ের দিকে এবং একটি গ্রুপ পার্কের মোড়ের দিকে অবস্থান করে। শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে এরই মধ্যে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহানগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মোটরসাইকেল নিয়ে পার্কের মোড়ে চলে আসে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লাঠিসোঁটা, দাসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করে। পুলিশও লাঠিচার্জ করে ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ-যুবলীগ- স্বেচ্ছাসেবক লীগের মাঝে ইটপাটকেল নিক্ষেপের এক পর্যায়ে পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট বন্ধ করে পুলিশ, আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নেয়। মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা মারমুখী হয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। এ সময় তারা স্লোগান দেয় ‘পা চাটলে সতী, না চাটলে জঙ্গি, চাইতে গেলে অধিকার, হয়ে যায় রাজাকার। তুমি কে, আমি কে রাজাকার, রাজাকার, এ কথা বলেছে সরকার সরকার। কোটা প্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক। বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পলিটেকনিকের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী যোগ দেন। এতে আন্দোলন তীব্র হলে পুলিশ গাড়িসহ উপাচার্যের বাসভবনে গেটের তালা মেরে ভেতরে অবস্থান নেয়। বিকাল সাড়ে ৪টার পর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ভেতরে ছাত্রলীগ সহ আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ধাওয়া দেয়। এতে তারা দিগি¦দিক ছুটে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে অবস্থান নিয়ে নিহত শিক্ষার্থীদের হত্যাকারীদের বিচারের দাবি জানিয়ে আসছিল। বর্তমানে লালবাগ থেকে পার্কের মোড় পর্যন্ত থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
ওদিকে বিকাল ৫টার দিকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে শিক্ষার্থীরা লাশ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তারা কাচারি বাজার আসলে পুলিশ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লাশ নিয়ে যায়। এতে শিক্ষার্থীরা কাচারি বাজারে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। এর এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনে যোগ দেয়।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থী সিয়াম বলেন, কোটা আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আজ আমার ভাই মারা গেছে। আমি হত্যাকারীদের বিচার চাই। বন্ধুর লাশের ভার আমরা বইতে পারছি না। এর উচিত বিচার করতে হবে।
শিক্ষার্থী মামুন মিয়া বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা করা হয়েছে। পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ সবাই মিলে হামলা চালিয়েছে। আমরা ছাত্ররা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবো। রংপুর মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. আজোয়ারী বলেন, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০ জনের অধিক শিক্ষার্থী বিভিন্ন ইনজুরি নিয়ে ভর্তি হয়েছেন। তাদের চিকিৎসা চলছে। এর মধ্যে আবু সাঈদ হাসপাতালে আসার আগেই মারা গিয়েছিলেন।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার আবু মারুফ হোসেন বলেন, কোটা পদ্ধতি সংস্কার আন্দোলনের পরিস্থিতি এখন ভালো নেই। শিক্ষার্থীরা মারমুখী অবস্থানে রয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় সড়ক অবরোধসহ হামলা করা হচ্ছে। আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিজিবি ফোর্স চেয়েছি।