মার্কিন শুল্ক: আলোচনা চলছে অগ্রগতি নেই এখনো

মার্কিন শুল্ক: আলোচনা চলছে অগ্রগতি নেই এখনো

প্রথম নিউজ, অনলাইন: শুল্ক ছাড় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় ৩ দিনের আলোচনার প্রথম দিন অতিবাহিত হয়েছে। ‘শুরুটা চমৎকার হয়েছে’ দাবি করে ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র জানিয়েছে- নিয়মিত বিরতিতে এটি ১১ই জুলাই অবধি চলবে। তবে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত বাংলাদেশের জন্য বর্ধিত ৩৫ শতাংশ শুল্কে ন্যূনতম ছাড় পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা তৈরি হয়নি এখনো। স্মরণ করা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রথম দফা আলোচনার পরপরই ৩৭ থেকে ২ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ বর্ধিত শুল্ক বহাল থাকার চিঠি পায় ঢাকা। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে লেখা ট্রাম্পের ওই চিঠিতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতি দূর হলে এটি আরও কমতে পারে বলে আভাস দেয়া হয়। সে হিসেবে ৩১শে জুলাইয়ের মধ্যে বিষয়টির কাঙ্ক্ষিত সমাধান হতে হবে। তা না হলে ১লা আগস্ট থেকে রপ্তানিতে বর্ধিত হারে শুল্ক গুনতে হবে। এমন প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় দফা আলোচনার ডাক পায় বাংলাদেশ। ৯ই জুলাই থেকে ওয়াশিংটনে

তিনদিনের আলোচনা শুরু হয়েছে। স্থানীয় সময় সকাল ১১টায় শুরু হওয়া আলোচনাটি মুলতবি হয় ওই দিন বিকাল ৫টায় (বাংলাদেশ সময় রাত তিনটা)। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত আলোচনা যেখানে থামে, সেখান থেকেই শুক্রবার দিনব্যাপী আলোচনা হবে। সূত্রমতে, বাংলাদেশি পণ্যে শুল্ক ছাড় পেতে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আছে, এমন দেশের পণ্যের ওপর বিধিনিষেধ বাংলাদেশকে মেনে চলতে হবে। এতে করে বাংলাদেশের বৈশ্বিক বাণিজ্য সীমিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশ ডব্লিউটিওর বিধান মেনে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক এগিয়ে নিচ্ছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে একটি দেশের বাণিজ্যনীতিতে পরিবর্তন কতোটা আনা সম্ভব এবং অন্য দেশের ক্ষেত্রে এর প্রভাব কী হবে, সেটাও বিবেচ্য। সামগ্রিকভাবে বাণিজ্যনীতিতে পরিবর্তনের বিষয়টি রাজনৈতিকও বটে।

নতুন কোনো প্রস্তাব নেই বাংলাদেশের, তবুও সাফল্যের আশাবাদ: যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের সংবাদদাতা কাউসার মুমিন জানিয়েছেন- ওয়াশিংটন ডিসিতে চলমান তিনদিনব্যাপী ট্যারিফ আলোচনার প্রথম দিনের ফলাফলে সন্তুষ্ট বাংলাদেশ। ওই আলোচনার সমাপনীতে একটি সফল ট্যারিফ চুক্তিতে পৌঁছানোর বিষয়ে আশাবাদী ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাস। দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা মানবজমিনের সঙ্গে আলাপে বলেন, প্রথম দিনের আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কৃষি, বাণিজ্য, জ্বালানি, মেধাস্বত্বসহ সকল সেক্টরের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল তাদের অবস্থানের পক্ষে যুক্তিগুলো তুলে ধরেছে এবং মার্কিন পক্ষ তা মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। যদিও তারা কোনো সিদ্ধান্ত দেননি-কিন্তু, তারা কোনো আপত্তি তুলেননি। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শুক্রবার জানা যাবে।

বুধবারের বৈঠকে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন। ঢাকা থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব। এ ছাড়া বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে ছিলেন বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. নাজনীন কাওসার চৌধুরী এবং বাংলাদেশ দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ডিএম সালাহউদ্দিন মাহমুদ। বৈঠকের সাইড লাইনে মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টার বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, গত ২৭শে জুন অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ প্রথম দফার আলোচনায় বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস করতে যুক্তরাষ্ট্রকে যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফুড ড্রিংক, বোয়িং বিমান ও সামরিক সরঞ্জাম আমদানি। পাশাপাশি আমদানি পণ্যে ধাপে ধাপে শুল্ক, ভ্যাট ও অন্যান্য ডিউটি কমানোর প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ। বুধবারের আলোচনায় এর বাইরে ‘যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন কোনো বড় আকারের বাণিজ্য সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব করেছে কিনা বাংলাদেশ যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি আরও হ্রাস পায় এবং বাংলাদেশ উপকৃত হয়- এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রেস মিনিস্টার জানান, ‘বড় আকারের কোনো বাণিজ্য সুবিধা দেয়ার কিছু নেই এবং এমন কোনো সুযোগ নেই’।

তিন মাস আগে ঘোষিত ট্যারিফ আলোচনার সময়সীমা ছিল ৯ই জুলাই, সেখানে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সময় নির্ধারণ করা হলো ৯ থেকে ১১ই জুলাই। যদিও বর্তমানে নয়া ডেডলাইন ১লা আগস্ট। আপনার কি মনে হয় বাংলাদেশ ট্যারিফ আলোচনা শুরু করতে দেরি করেছে? জবাবে প্রেস মিনিস্টার বলেন, ‘উভয় দেশের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বৈঠক ২৭শে জুন শুরু হলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্তরালে খুব গোপনে আলোচনা চলছে দীর্ঘদিন থেকেই, যা মিডিয়াতে আসেনি। এমনকি আজকের আলোচনার জন্যও আমাদের কোনো প্রেস রিলিজ নেই। এই আলোচনা এমনটাই গোপনে চলছে যে, কাউকে কোনো ছবিও তুলতে দেয়া হয়নি।’  বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম গত সপ্তাহেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ২০ শতাংশ ট্যারিফ নিশ্চিত করে চুক্তিতে উপনীত হয়েছে।

আর আমরা এখনো প্রথম ডেডলাইন পেরিয়ে যাওয়ার পর আলোচনা করছি- এমন প্রশ্নের জবাবে গোলাম মোর্তোজা বলেন, ‘ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ২০ শতাংশ ট্যারিফ চুক্তির বিষয়টি সঠিক নয়,  আমি সাংবাদিক হলে বিষয়টি নিয়ে আরও খোঁজখবর নিতাম।’ গত ২রা জুলাই ২০২৫ প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প নিজেই ট্রুথ সোশ্যালে জানান যে, ভিয়েতনামের সঙ্গে ২০ শতাংশ ট্যারিফ আরোপের চুক্তি হয়েছে, তবে দেশটির ভেতর দিয়ে ট্রান্সশিপ করা চীনা বা তৃতীয় কোনো দেশের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ হবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ‘এটি আমার জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয় যে, আমি সমপ্রতি ভিয়েতনাম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করেছি।’ ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে এবং দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের ৫ম বৃহত্তম বাণিজ্য ঘাটতির দেশ।

 ট্রাম্পের শীর্ষ বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারোর জন্য ভিয়েতনাম একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয় ছিল। তিনি এপ্রিল মাসে ফক্স নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভিয়েতনামকে ‘মূলত কমিউনিস্ট চীনের একটি উপনিবেশ’ বলে বর্ণনা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভিয়েতনামের কয়েক সপ্তাহের দীর্ঘ আলোচনার পর এই চুক্তি সম্পন্ন হয়। আলোচনায় ভিয়েতনামকে বাণিজ্য জালিয়াতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে, চীনা পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এবং সকল অশুল্ক বাধা দূর করতে চাপ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। অপরদিকে ভিয়েতনাম সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহার করার প্রস্তাব দেয় এবং আরও বেশি আমেরিকান পণ্য কেনার প্রতিশ্রুতি দেয়। দেশটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রে সফর করেন সমর্থন জোগাড় করতে এবং চুক্তি স্বাক্ষর করতে, যার মধ্যে ছিল ৩০০ কোটি ডলারের কৃষিপণ্যের চুক্তি।

ভিয়েতনামের বাণিজ্যমন্ত্রী নাইকি, গ্যাপসহ অন্যান্য কোম্পানির নির্বাহীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, যাতে তারা আলোচনায় ভিয়েতনামের পক্ষে সমর্থন জানায়। চুক্তি সম্পাদনে মরিয়া ভিয়েতনামের কর্মকর্তারা এমনকি ট্রাম্প অর্গানাইজেশনের ১৫০ কোটি ডলারের বিলাসবহুল রিসোর্ট কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন, যে প্রকল্পে পাঁচতারকা হোটেল, গলফ কোর্স ও আবাসিক এলাকা থাকবে, যার মোট আয়তন ৯৯০ হেক্টরেরও বেশি। বিগত মে মাসে এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ছেলে এরিক ট্রাম্প অংশ নেন, যেখানে ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী ফাম মিন চিনও উপস্থিত ছিলেন।