ব্যাংকে নগদ টাকার টানাটানি

চলতি অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রির বিপরীতে বাজার থেকে তুলে নিয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা

ব্যাংকে নগদ টাকার টানাটানি
ফাইল ফটো

প্রথম নিউজ, ঢাকা: রমজান এলে এমনিতেই ব্যবসায়ীদের টাকা উত্তোলনের চাহিদা বাড়ে। এবার ডলার সঙ্কটে এই চাহিদা আরও বেড়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ঈদের আগে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে বোনাস দিতে হচ্ছে। মাস শেষ হওয়ার আগেই অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন বুঝিয়ে দিচ্ছে। আবার চলতি অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রির বিপরীতে বাজার থেকে তুলে নিয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এসব কারণে মুদ্রাবাজারে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে।

এর ফলে অনেক ব্যাংক নগদ টাকার সংকটেও পড়েছে। সংকট মেটাতে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এতে কলমানিতে বুধবার (২৭ এপ্রিল) রেকর্ড পরিমাণ লেনদেন হয়েছে। একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও টাকা ধার বেড়েছে। এ জন্য ঈদের আগে টাকা ধার দিতে বিশেষ ব্যবস্থাও নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে করে আন্তঃব্যাংক ধার বা কলমানির সুদহার  বেড়ে গেছে। সার্বিকভাবে মুদ্রাবাজারে টাকার টানাটানি শুরু হয়েছে।

টানাটানির চার কারণ: এ প্রসঙ্গে একটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডি জানান, চার কারণে ব্যাংক খাতে টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। প্রথমত, অন্য যে কোনও সময়ের চেয়ে এবারে ভোগ্যপণ্যের মূল্য বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে টাকার ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ ঈদের প্রয়োজনে অনেকেই ব্যাংকের আমানত তুলে নিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, ডলারের পেছনে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। তৃতীয়ত, ঈদের আগে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে বোনাস দিতে হচ্ছে। মাস শেষ হওয়ার আগেই অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন বুঝিয়ে দিচ্ছে। চতুর্থ কারণ,  রেপোর মাধ্যমে ধার ছিল, সেটা শোধ দিয়ে সরকারি বিল বা বন্ডকে অবমুক্ত করতে অনেক টাকা আটকে গেছে।

ডলারে আটকে যাচ্ছে টাকা: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় ডলার সংকট মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ধরনা দিচ্ছে অনেক ব্যাংক। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৪৬০ কোটি (৪.৬০ বিলিয়ন) ডলার বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে, কোনো অর্থবছরে এতো ডলার বিক্রির প্রয়োজন পড়েনি।

কমে গেছে আমানত: দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ব্যাংকে কমে যাচ্ছে আমানত প্রবাহ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) আমানতের প্রবৃদ্ধি যেখানে ছিল প্রায় সাড়ে ৪৩ শতাংশ, সেখানে চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কমে গেছে ৫১ দশমিক ৫১ শতাংশ। গত অর্থবছরের সাত মাসে ব্যাংকিং খাতে আমানত সংগ্রহ হয়েছিল যেখানে এক লাখ পাঁচ হাজার ১০৮ কোটি টাকা, সেখানে চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে হয়েছে ৫০ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা।

চাপ বেড়েছে কল মানি মার্কেটে: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারিতে ব্যাংক খাতে নগদ অর্থ ছিল ২৯ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা, গত ফেব্রুয়ারিতে যা কমে হয় দাঁড়ায় ২৬ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে দৈনন্দিন কার্যক্রম মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। বাধ্য হয়ে বেশ কিছু ব্যাংক কলমানি থেকে টাকা ধার করছে। কলমানি হলো এক দিন ও রাতের জন্য টাকা ধার নেওয়ার সুযোগ। যদিও গত জানুয়ারিতে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা, গত ফেব্রুয়ারিতে ৭ হাজার কোটি টাকা কমে গেছে। মার্চেও কমেছে প্রায় একই সমান সমান। বর্তমানে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য এক লাখ কোটি টাকার ঘরে নেমে এসেছে। উদ্বৃত্ত তারল্যের সিংহভাগ ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী,  বুধবার (২৭ এপ্রিল) কলমানিতে ৮ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। এতে গড় সুদহার ছিল ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এদিন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ১৫৯টি লেনদেন সম্পন্ন করে। বুধবার যে লেনদেন হয়, তা ছিল গত ৯ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ।

কলমানি মার্কেটের বাইরেও চাপ: ব্যাংকগুলো কলমানি মার্কেটের বাইরেও এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে, যা আন্তব্যাংক রেপো নামে পরিচিত। এখানেও টাকা ধার নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে এবং সুদহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। গত ২৪ এপ্রিল ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে ২ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা লেনদেন করেছে। এতে সুদহার ছিল ৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ। পরের দিন ২৫ এপ্রিল লেনদেন হয় ৩ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা। ২৬ এপ্রিল লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। এদিন সুদহার ৪ দশমিক ৯৩ শতাংশে উন্নীত হয়।

অনীহা ট্রেজারি বিল ও বন্ডে: টানাটানির কারণে অনেক ব্যাংক এখন আগের মতো সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে টাকা খাটাতে চাইছে না। যে কারণে ট্রেজারি বিলের সুদহারও বাড়তির দিকে। গত ৪ এপ্রিল এক বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিলে গড়ে ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ সুদে এক হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয় সরকার। এরপর ৬ এপ্রিল দুই বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের বিপরীতে দেড় হাজার কোটি টাকা উত্তোলনের নিলাম ডাকা হয়। তবে বাজার থেকে নেওয়া হয় মাত্র ২৫ কোটি টাকা, যেখানে গড় সুদহার ছিল ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ। যদিও বিভিন্ন ব্যাংক ২ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা সরবরাহের জন্য নিলামে অংশ নিয়েছিল। তবে পুরো অর্থ তুললে বাজারে চাপ বাড়বে এরকম ধারণা থেকে বাকি এক হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা সরবরাহ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সিআরআর সংরক্ষণে হিমসিম খাচ্ছে ব্যাংক: ব্যাংকিং খাতে হঠাৎ টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে।  ব্যাংকগুলোর বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার (সিআরআর) সংরক্ষণ করতে হিমশিম খেতে হয় ব্যাংকারদের। জরিমানা এড়াতে ব্যাংকগুলোকে কলমানি মার্কেটে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom