পিয়াজের মতো চিনির দাম বাড়ার আশঙ্কা

পিয়াজ রপ্তানিতে শুল্ক আরোপের পর এবার চিনি রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত, যা অক্টোবর থেকে কার্যকর করতে যাচ্ছে দেশটি।

পিয়াজের মতো চিনির দাম বাড়ার আশঙ্কা

প্রথম নিউজ, অনলাইন: পিয়াজ রপ্তানিতে শুল্ক আরোপের পর এবার চিনি রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত, যা অক্টোবর থেকে কার্যকর করতে যাচ্ছে দেশটি। এতে বাংলাদেশের বাজারেও পিয়াজের মতো চিনির দাম বাড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি- বাংলাদেশ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাসহ অন্য দেশ থেকে প্রক্রিয়াজাত ও অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে। তাই ভারতের চিনি রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তের কোনো প্রভাবই পড়বে না দেশের বাজারে। 

এদিকে বিশ্ববাজারে ধারাবাহিকভাবে বেশ কিছু ভোগ্যপণ্যের দাম কমছে। দেখা যাচ্ছে গত ৫ মাসের ব্যবধানে গম, চিনি, পাম অয়েলের মতো নিত্যপণ্যের দাম অনেকখানিই কমেছে। তবে দেশের বাজারে দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই, উল্টো আরও বাড়ছে। আবার কিছু পণ্যের দাম কেজিতে ২০ থকে ২৫ টাকা কমার কথা থাকলেও চড়া দামেই স্থিতিশীল রয়েছে।

বিশ্ববাজারে দাম কমার পরও দেশের বাজারে দাম না কমায় ব্যবসায়ীরা বাড়তি মুনাফা লুটে নিচ্ছে আর ভোক্তার পকেট খালি হচ্ছে। সরকারের যথাযথ মনিটরিং না থাকার কারণে ব্যবসায়ীরা আরও বেপরোয়া হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, দেশে চিনি পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ বেশির ভাগ চিনি আমদানি করে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে। তাই ভারত চিনি রপ্তানি বন্ধ করলেও এর কোনো প্রভাব দেশের বাজারে পড়বে না। 

বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স এসোসিয়েশন গত ১৩ই আগস্ট চিনির দাম কেজিতে ৫ টাকা কমানোর কথা জানিয়েছিল। বলেছিল ১৪ই আগস্ট থেকে ৫ টাকা কমে প্রতি কেজি খোলা চিনি ১৩০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ১৩৫ টাকায় বিক্রি হবে। কিন্তু দুই সপ্তাহ পরেও তার প্রভাব দেখা যায়নি ঢাকার খুচরা বাজারে। তবে একই সময় ভোজ্য তেলের দাম লিটারে ৫ টাকা কমানোর যে সিদ্ধান্ত এসেছিল, সেটির প্রভাব বাজারে দেখা গেছে। ঢাকার কয়েকটি কাঁচাবাজারের দোকান ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিকেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকায় এবং প্যাকেটজাত ১৪০ টাকায়। বিক্রেতারা জানান, আমার চিনি কেনা নতুন দাম নির্ধারণের আগে। ফলে ১৩৫ টাকার নিচে কোনোভাবেই বিক্রি করতে পারবো না।

চিনির দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সরকার নিয়ন্ত্রক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করে। তবে সেই সুবিধা ৩০শে মে’র পর নতুন করে বাড়ানো হয়নি। গত ২৬শে ফেব্রুয়ারি এনবিআর প্রতি টন অপরিশোধিত চিনি আমদানির ওপর থেকে ৩ হাজার টাকা এবং প্রতি টন পরিশোধিত চিনির ওপর থেকে ৬ হাজার টাকা শুল্ক প্রত্যাহার করে। এ ছাড়া চিনি আমদানিতে নিয়ন্ত্রক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করেছে। শুল্ক কমানোর পর আমদানি পর্যায়ে অপরিশোধিত ও পরিশোধিত চিনির সামগ্রিক আমদানি ব্যয় যথাক্রমে প্রতি টনে সাড়ে ৬ হাজার টাকা ও ৯ হাজার টাকা কমে যাওয়ার কথা। তারপরও চিনির দাম কমার লক্ষণ নেই। 

পরিশোধনকারীদের নির্ধারিত নতুন দরের বদলে এখনো আগের দরে চিনি বিক্রির বিষয়ে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, সরকারের বেঁধে দেয়া দাম অনুযায়ী চিনি ও সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে কিনা- তা দেখতে আমরা ইতিমধ্যে অভিযান পরিচালনা শুরু করেছি। অভিযানে আমরা খুচরা ব্যবসায়ীর কাছে কোন সময়ের কেনা- তার রসিদ দেখছি। যাদের চিনি কেনা ১৪ই আগস্টের আগে, তারা ৫ টাকা অতিরিক্ত দামে বিক্রি করলেও তাদেরকে আমরা ছাড় দিচ্ছি। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে সয়াবিনের মতো চিনিও নির্ধারিত দামে বিক্রি নিশ্চিত হবে বলে আশা তার।

জানা গেছে, সাত বছরের মধ্যে এবারই প্রথম ভারত চিনি রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। পাশাপাশি থাইল্যান্ডও চিনি রপ্তানি কমাতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে প্রক্রিয়াজাত ও অপরিশোধিত চিনি রপ্তানিকারক দেশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার ওপর চাপ বাড়বে। এ দুটি দেশ চাহিদা মতো চিনির যোগান দিতে না পারলে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে দেশের বাজারে। বিশ্ববাজারে চিনির দাম কমেছে ৪ শতাংশ: বিশ্ববাজারে গত মাসে চিনির দাম কমেছে ৩.৯ শতাংশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানায়, গত জুলাই মাসে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম আগের মাসের চেয়ে বেড়েছে ১.৩ শতাংশ। যদিও তা ২০২২ সালের জুলাই মাসের চেয়ে ১১.৮ শতাংশ কম।

ব্রাজিল ও ভারতে আবাদ বেড়েছে, এর বিপরীতে চাহিদা কমেছে ইন্দোনেশিয়া ও চীনের। দুগ্ধপণ্যের দামও গত মাসে কমেছে ০.৪ শতাংশ।
বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশের বাজারে চিনির দাম বিগত কয়েক মাসে বেশি বেড়েছে। অথচ বিশ্ববাজারে কমেছে। ইনডেক্স মুন্ডির তথ্য বলছে, গত এপ্রিল মাসে ১ কেজি চিনির দাম ছিল ৬৫ সেন্ট। টাকার অঙ্কে যা হয় (১ ডলার= ১০৮ টাকার হিসাবে) ৭০ টাকা। মে মাসে কমে হয় ৫৪ সেন্ট বা ৫৮ টাকা ৩২ পয়সা। জুন মাসে হয় ৪৮ সেন্ট বা ৫১ টাকা ৮৪ পয়সা, জুলাই মাসে হয় ৪৩ সেন্ট বা ৪৬ টাকা ৪৪ পয়সা এবং আগস্টে কমে হয়েছে ৪২ সেন্ট বা ৪৫ টাকা ৩৬ পয়সা। অথচ দেশের বাজারে এখনো প্যাকেটজাত চিনির কেজি ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা এবং খোলা চিনির কেজি ১৩০ টাকা। 

কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, বিদেশে যখন পণ্যের দাম বাড়ে তখন ব্যবসায়ীরা দেশের বাজারে সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু বিশ্ববাজারে কমলে তখন আর কমানো হয় না। কখনো সরকারের চাপে কিছুটা দাম কমালেও সেটি ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। এর সুফল পায় না ভোক্তারা। এটা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের চরম অসাধুতা। বিশ্ববাজারে দাম কমার ফলে তারা অস্বাভাবিক মুনাফা লুটে নিচ্ছে, অথচ ভোক্তার কোনো লাভ হচ্ছে না। এখানে সরকারের তদারকিরও ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে।

চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন সুগার রিফাইনারি এসোসিয়েশনের মহাসচিব গোলাম রহমান বলেন, ভারত রপ্তানি বন্ধ করলে বিশ্ববাজারে চিনির দাম বাড়তে পারে। তাতে দেশে আমদানি ও সরবরাহ নিয়ে খুব সমস্যা হবে না। কারণ, অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা যাবে। তবে এ জন্য চিনি আমদানির ঋণপত্র খুলতে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, তা এখনই নিশ্চিত করতে হবে।