আমানতের সুদে সীমা থাকছে না, ভোক্তা ঋণে বাড়লো সুদ

রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।

আমানতের সুদে সীমা থাকছে না, ভোক্তা ঋণে বাড়লো সুদ
আমানতের সুদে সীমা থাকছে না, ভোক্তা ঋণে বাড়লো সুদ

প্রথম নিউজ, অনলাইন: নতুন মুদ্রানীতিতে পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের আমানতের ওপর বেঁধে দেয়া সুদহার তুলে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমানতের সুদহার নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারবে। অন্যদিকে ভোক্তা ঋণের (ব্যক্তিগত ঋণ, গাড়ি ঋণ, আবাসন ঋণ, শিক্ষা ঋণ প্রভৃতি) সুদহার ৩ শতাংশ বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে শেষ হলো ব্যাংক ঋণের নয়-ছয় সুদহার ব্যবস্থা। এ ছাড়া পরিবর্তন আনা হয়েছে নীতি সুদহারে। গতকাল চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ ৬ মাসের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে এ ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে নতুন এ মুদ্রানীতি ‘মনিটরি পলিসি স্টেটমেন্ট (এমপিএস)’ প্রকাশ করা হয়। আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর এটি প্রথম মুদ্রানীতি। এবারের মুদ্রানীতিকে সতর্কমূলক বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল, কাজী ছাইদুর রহমান, আবু ফরাহ মো. নাছের, এ কে এম সাজেদুর রহমান খান, বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস, প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হকসহ গবেষণা বিভাগের সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। নতুন মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার পুরোপুরি তুলে নেয়া হলো। এ ছাড়া নতুন মুদ্রানীতিতে ভোক্তা ঋণের সুদহার বাড়ানোরও ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে সুদহার ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। বর্তমানে ব্যাংকের সব ধরনের ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে বেঁধে রাখা হয়েছে। এখন সেখানে ভোক্তা ঋণের সুদহার বাড়িয়ে ১২ শতাংশ পর্যন্ত করতে পারবে ব্যাংকগুলো। এর ফলে ব্যাংকগুলো এখন ভোক্তা ঋণের সুদহার বাড়াতে পারবে। তবে শিল্পঋণসহ অন্যান্য ঋণের ক্ষেত্রে সুদহার বাড়ানোর সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা দেয়া হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, অন্যান্য ঋণের বেঁধে দেয়া সুদহার তুলে নেয়ার বিষয়টি বিবেচনাধীন থাকবে।
মুদ্রানীতিতে বলা হয়, আমানতের সুদহার উন্মুক্ত করে দেয়া ও ঋণ সুদহারে কিছুটা শিথিল করায় তা আমানতের সুদহার বাড়াতে সহায়তা করবে। এর আগে ২০২১ সালের আগস্টে আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার বেঁধে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, তিন মাস ও তার বেশি মেয়াদি আমানতের সুদ কোনোভাবেই তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতির কম হতে পারবে না। ২০২০ সালের এপ্রিলে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়ার পর আমানতের সুদহার আড়াই শতাংশে নামিয়ে এনেছিল। বর্তমানে দেশে মূল্যস্ফীতি যেখানে উঠেছে, তাতে ব্যাংকগুলোকে আমানতের সুদহারও বাড়াতে হয়। কিন্তু ঋণের সুদ নির্দিষ্ট থাকায় ঋণ ও আমানতের সুদের মধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোকে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। এজন্য ব্যাংকগুলো ঋণ ও আমানতের সুদহার তুলে নেয়ার দাবি করে আসছিল। নতুন মুদ্রানীতিতে আবারো নীতি সুদহার বাড়ালো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন করে রেপো ও রিভার্স রেপোর সুদহার ২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়। নতুন মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, রেপো সুদহার ৫.৭৫ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন হবে ৬ শতাংশ। আর রিভার্স রেপোর ক্ষেত্রে সুদের এই হার ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪.২৫ শতাংশ করা হয়েছে।
ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে ব্যবস্থায় টাকা ধার নেয়, সেটি রেপো নামে পরিচিত। আর রিভার্স রেপো হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যে টাকা জমা রাখে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত এই টাকা তখন জমা নেয়, যখন বাজার থেকে অতিরিক্ত তারল্য বা টাকা তুলে নেয়ার প্রয়োজন হয়। রেপো সুদহার বাড়ানোর ফলে ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে বেশি সুদ গুনতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে মূলত বাজারে টাকার প্রবাহ কমাতে। কারণ, সুদহার বেশি থাকলে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কম টাকা ধার করবে। অন্যদিকে রিভার্স রেপোর সুদহার বাড়িয়ে আবার বাংলাদেশ ব্যাংকগুলোর টাকা জমা নেয়ার ক্ষেত্রে বাড়তি মুনাফা দেয়ার সুযোগও রাখলো। এতে করে ব্যাংকগুলোর যদি অতিরিক্ত টাকা থাকে, তাহলে তারা সেই টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রেখে সেখান থেকে আয় করার সুযোগ পাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ প্রশমন, বিনিময় হারের চাপ নিয়ন্ত্রণ, সরকারের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় অর্থের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতে ঋণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে মুদ্রানীতিতে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বলেন, আমরা একটি চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছি। এ কারণে বর্তমান বাজার পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার পুরোপুরি তুলে নেয়া হয়েছে।
ব্যাংকের আমানত গত বছরের চেয়ে ৮ শতাংশ বেড়েছে। আমানতের সুদহার উন্মুক্ত করে দেয়া ও ঋণ সুদহারে কিছুটা শিথিল করায়, তা আমানতের সুদহার বাড়াতে সহায়তা করবে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নতুন করে ৬.৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। আর মূল্যস্ফীতি ৭.৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থ পাচার রোধ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বেশকিছু পণ্যের ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের তথ্য রয়েছে। তবে ওভার ইনভয়েসিং অনেকটা কমেছে। যেকোনো একটা ধাক্কায় বাংলাদেশের অর্থনীতি নড়ে যাবে না উল্লেখ করে আব্দুর রউফ বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধ, ফেডারেল ব্যাংকের আগ্রাসী সুদহার ও চীনের করোনা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ মাসে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৩৩.৩ শতাংশ, অর্জন হয়েছে ২৬.৬ শতাংশ। আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৩.৬ শতাংশ, হয়েছে ১২.৮ শতাংশ।
সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৬.৯ শতাংশ, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫.১ শতাংশ। আর ২০২৩ সালের জানুয়ারি-জুন সময়ের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৩৭.৭ শতাংশ, যেখানে গত বছরে জুনে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে তা ধরা হয়েছিল ৩৬ শতাংশ। আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪.১ শতাংশ, গত জুনেও একই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৮.৫ শতাংশ, গত জুনে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে যা ধরা হয়েছিল ১৮.২ শতাংশ।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: