দেশে রাশিয়ান ওলিগার্কের মতো শ্রেণি তৈরি হয়েছে

গতকাল রাজধানীর কেআইবিতে ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন আখ্যান ও সমান্তরাল বাস্তবতা: পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভাবনা’ শীর্ষক নাগরিক প্লাটফর্মের সংলাপ ও জনপ্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব বলেন সংগঠনটির আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

দেশে রাশিয়ান ওলিগার্কের মতো শ্রেণি তৈরি হয়েছে

প্রথম নিউজ, অনলাইন: দেশে রাশিয়ান ওলিগার্কের মতো শ্রেণি তৈরি হয়েছে। যারা সম্পদশীল ও রাজনৈতিকভাবে খুবই প্রভাবশালী। যার ফলে আয় বৈষম্য খুব দ্রুতই বাড়ছে। আর এই বৈষম্য বাড়ার পেছনে রয়েছে মূলত ৪টি কারণ। সেগুলো হলো- ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি না পাওয়া, রাজস্ব আদায় অগ্রগতি না হওয়া, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে স্বল্প বরাদ্দ দেয়া এবং সামাজিক সুরক্ষায় ঘাটতি থাকা। এদিকে গত এক যুগে দেশে ধনী-গরিব বৈষম্য বেড়েছে ৮০ গুণ। দেশের উন্নয়ন হলেও এর সুফল পৌঁছায়নি সবার কাছে, যা আগামীতে টেকসই উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে। 

গতকাল রাজধানীর কেআইবিতে ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন আখ্যান ও সমান্তরাল বাস্তবতা: পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভাবনা’ শীর্ষক নাগরিক প্লাটফর্মের সংলাপ ও জনপ্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব বলেন সংগঠনটির আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। নাগরিক প্ল্যাটফর্মের দেয়া তথ্যমতে, দেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ৭.১ শতাংশ। আকার বেড়ে ৪৬০ বিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৬৮৭ ডলার। গত ৬ বছরে দারিদ্র্যের হার কমে বর্তমানে হয়েছে ১৮.৭ শতাংশ। অতি দারিদ্রের হারও কমে দাঁড়িয়েছে ৫.৬ শতাংশে।   

নাগরিক প্ল্যাটফর্ম মনে করে, দেশের উন্নয়ন হলেও এর সুফল সবাই পায়নি। আয় বৈষম্য বেড়েছে। ২০১০ সালে সবচেয়ে ধনী ও দরিদ্র ৫ শতাংশ মানুষের আয়ের পার্থক্য ছিল ৩০ গুণ। ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৮০ গুণ। যাদের কাছে বেশি সম্পদ তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতাও অনেক বেশি, যা আগে কখনোই দেখা যায়নি।

এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জানান, গত ৫০ বছরে দেশে উন্নয়নের আদর্শ স্থাপন হলেও আয় ও ব্যয়ে বৈষম্য, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অদক্ষতা, দুর্নীতি, জবাবদিহিতার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছায়নি। ধনী-দরিদ্রের এমন বৈষম্য চলতে থাকলে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা বাড়বে। এই অন্যায্যতা আগামীতে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করবে, যা উদ্বেগের বিষয়। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, জিডিপি, জাতীয় আয়, রপ্তানি রেমিট্যান্স, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সব সূচকে উন্নতি হলেও সবাই এর সমান ভাগিদার হতে পারেননি। খাতভিত্তিক, জনসংখ্যাভিত্তিক ও এলাকাভিত্তিক বৈষম্যের কারণে অনেকেই এই উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

তিনি বলেন, দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ে নাই, যেটা বেড়েছে সেটা সরকারি বিনিয়োগ। শুধু সরকারি বিনিয়োগ দিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ নিয়ে ড. দেবপ্রিয় বলেন, মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের পথে একটি দেশে জিডিপি’র ২ শতাংশের চেয়ে বরাদ্দ শিক্ষাখাতে এবং ১ শতাংশের কম বরাদ্দ স্বাস্থ্যখাতে। এটা কলঙ্কজনক বিষয়। প্রশ্ন তোলেন সামাজিক সুরক্ষা ও বরাদ্দের হিসাব নিয়েও। ফলে দেশের উন্নয়ন হলেও তা সঠিক বণ্টন হয়নি বলে মন্তব্য করেন প্লাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বলেন, এখন এক দেশে দুটো ভিন্ন সমাজে দাঁড়িয়েছে, ভিন্ন বাস্তবতা বিরাজ করছে। একদিকে উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু এর ভাগীদার সবাই হতে পারে নাই। ফলে সব শেষ হিসাব অনুযায়ী দেশের শীর্ষ ধনীদের ১০ শতাংশ মানুষের কাছে মোট সম্পদের ৪১ শতাংশ। অপরদিকে সবচেয়ে গরীব ১০ শতাংশ মানুষের কাছে আছে মোট সম্পদের ১ দশমিক শূণ্য ২ শতাংশ। যা বলে দেয় বৈষম্যের পরিমাণ।

এ সময় রেহমান সোবহান বলেন, অবকাঠামো উন্নয়নেও অঞ্চল ভেদে বৈষম্য দেখা যায়। ১৫ বছর ধরে দুর্নীতিসহ নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা হলেও সমাধান হচ্ছে না। দেশের বড় প্রকল্পের জন্য নেয়া বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপের কারণে স্বাস্থ্যসহ সামাজিক নিরাপত্তা খাতে তুলনামূলক বরাদ্দ অনেক কম। যা দেশের জন্য দুঃখজনক বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আঞ্চলিক বৈষম্য, সহিংসতা ও দুর্নীতিকে বড় সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানে গুরুত্ব দেন সিপিডি’র চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের ট্রাস্ট্রি বোর্ডের চেয়ারম্যন অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ মেম্বার, এনজিও ও ব্যক্তিখাতের প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সিপিডি বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনিও আয় বৈষম্যের কথা তুলে ধরেন। বলেন, আমরা গড় হিসাবে অনেক ভালো করেছি, কিন্তু সমান্তরাল বাস্তবতার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সামগ্রিক থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে অনেক ধরনের অসাম্য ও বৈষম্য বিদ্যমান। জানান, বর্তমানে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ আয় পার্থক্য ৮০ গুণ, যা ২০০৫ সালে ছিল ৩০ গুণ। এ ধরনের বৈষম্য বজায় রেখে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব না বলেও মন্তব্য করেন মোস্তাফিজুর রহমান।

অনুষ্ঠানে মানবাধিকারকর্মী এডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, রাজনীতিবিদরা কোথায়, তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যায় না। বিভিন্ন জায়গায় জনগণের প্রতিনিধি নেই। যদি জনগণের প্রতিনিধি না থাকে তাহলে কীভাবে সেখানে মানুষের কথা উঠে আসবে।