দীর্ঘসূত্রতা কী? যা জানা জরুরি

দীর্ঘসূত্রতা কী? যা জানা জরুরি

প্রথম নিউজ, ডেস্ক : দীর্ঘসূত্রতা এমন একটি সাধারণ বিষয় যা প্রায় প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। হোক সেটা থালা-বাসনগুলিকে সিঙ্কে জমা করা কিংবা গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় কেনাকাটা অন্য দিনের জন্য ফেলে রাখা বা কর্মক্ষেত্রে উপস্থাপনার জন্য প্রস্তুতি নিতে শেষ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করা। যাই হোক না কেন, আমরা যা করতে চাই না, তা দেরিতে করতে চাওয়া বা তা নিয়ে গড়িমসি করা স্বাভাবিক। কিন্তু এই দীর্ঘসূত্রতা  কখন একটি মানসিক রোগ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে?  

কিছু ক্ষেত্রে এটি একটি মারাত্মক সমস্যা হিসেব ধরে নেওয়া হয় যা সমাধান করা দরকার। দীর্ঘসূত্রতার ফলে কী হতে পারে এবং এটি আপনার জীবনে কি ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, ঠিক কীভাবে এ থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে তা জানতে পড়তে থাকুন।

দীর্ঘসূত্রতা কি মানসিক অসুস্থতা?

দীর্ঘসূত্রতা কোনো মানসিক অসুস্থতা নয় এবং শুধুমাত্র দীর্ঘসূত্রতার উপর ভিত্তি করে কাউকে মানসিক রোগী বলা যাবে না। দীর্ঘসূত্রতা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি বিষয় এবং এটি কোনো মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধির লক্ষণও নয়। কিন্তু, এটাই সত্যি যে মানুষ অপ্রীতিকর, বিরক্তিকর বা কঠিন কাজগুলো এড়িয়ে চলে এবং একান্তই করতে হবে বলে সেগুলো করতে বিলম্ব করে। 

যাইহোক, যদি দৈনন্দিন জীবনের কাজগুলিতে দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত বিলম্ব ঘটতে থাকে, যেমন আপনার সাথে ভালো সম্পর্ক আছে এমন কাউকে টেক্সট করা কিংবা দেখা করতে যদি আপনি বিলম্ব করতে থাকেন এবং এগুলোর পাশাপাশি অন্যান্য সমস্যাও জটিল হতে থাকে যা আপনাদের মধ্যকার সম্পর্কের মধ্যে ফাটল তৈরি করে, তবে এটি একটি বড় সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। নিচে মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধিগুলির কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে যা দীর্ঘসূত্রতার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিতে পারে-

* সারাক্ষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বোধ করা।

* নিজেকে বিধ্বস্ত মনে করা।

* নিয়মিত ঘুমের ব্যাঘাত ঘটা।

* খাদ্যাভ্যাসের বড় পরিবর্তন।

* মেজাজ পরিবর্তন।

* প্রয়োজনীয় জিনিসের অপব্যবহার করা।

* সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সমস্যা হওয়া।

আপনি যদি দীর্ঘসূত্রতার মুখোমুখি হয়ে থাকেন এবং উপরের যেকোনো সমস্যার সম্মুখীন হন, তবে ধরে নিতে পারেন যে, আপনি কোন ছোটোখাটো সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে, অবশ্যই আপনাকে কাউন্সেলিং এর শরণাপন্ন হতে হবে। 

দীর্ঘসূত্রতা আসলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিখুঁত লোকজনদের সাথেই হয়ে থাকে, যারা আসলে সবকিছুতেই যথার্থতা খুঁজে থাকে। এখন করলে হয়তো কাজটি খুব একটা ভালো হবে না, তাই তারা পরবর্তী সময়ের জন্য জমিয়ে রাখে। অন্যরা তাদের সম্পর্কে কী ভাববে তা নিয়ে তারা এতটাই উদ্বিগ্ন থাকে যে, যে তারা তাদের কাজের ফলাফলের দায় এড়াতে তাদের ভবিষ্যতকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে।

কিছু বিলম্বকারীরা দাবি করে যে তারা চাপের মধ্যে আরও ভাল পারফরম্যান্স করে। কিন্তু যদিও তারা এটাতে আত্মতুষ্টিতে ভোগে, গবেষণা দেখায় যে, এটি সাধারণত ফলপ্রসূ  হয় না; পরিবর্তে, তারা আপাতদৃষ্টিতে প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে উঠতে উচ্ছ্বসিত বোধ করার জন্য শেষ মুহূর্তের কাজের অভ্যাস তৈরি করতে পারে।

দীর্ঘসূত্রতার মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলি কী?

মনোবিজ্ঞানীগণের মতে দীর্ঘসূত্রতার বিভিন্ন কারণ-

* কম আত্মবিশ্বাস থেকে উদ্বেগ।

* আত্মপ্রত্যয় গঠনের অভাব।

* সহজভাবে অপ্ছন্দের কাজগুলি সম্পূর্ণ করতে নিজেকে অনুপ্রাণিত করতে না পারা।  

গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, দীর্ঘসূত্রতা গুজব বা নেতিবাচক চিন্তাভাবনার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। যদিও দীর্ঘসূত্রতাকে একটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে বিবেচনা করা হয় না, তবে এটি মানসিক স্বাস্থ্যের চ্যালেঞ্জগুলির সঙ্গে যুক্ত। বেশ কিছু গবেষণায় দীর্ঘসূত্রতাকে বিষণ্নতা, উদ্বেগ এবং কম আত্মসম্মানবোধের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, দীর্ঘসূত্রিতা, হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (ADHD), অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার (OCD) এবং অন্যান্য অনেক রোগের সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। 

শর্তাবলী

দীর্ঘসূত্রতা এবং মানসিক স্বাস্থ্য উদ্বেগের মধ্যে কোনটি প্রথমে আসে তা জানা কঠিন। তবে, মানসিক অসুস্থতার লক্ষণগুলি, যেমন কোনো কাজ শুরু করার আগেই তার জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পরা এবং অল্পতেই ক্লান্তি অনুভব করা দীর্ঘসূত্রতার প্রথম লক্ষ্মণ যা এই ধরনের কাজগুলি গ্রহণ করাকে কঠিন করে তুলতে পারে। অন্যদিকে, কাজগুলো চাপ তৈরি করতে পারে যা মানসিক স্বাস্থ্যের উদ্বেগের কারণও হতে পারে। 

দীর্ঘসূত্রতা এবং ADHD

হাইপারফিক্সেশন হল ADHD এর আরেকটি উপসর্গ যা দীর্ঘসূত্রতার কারণ হিসেবে কাজ করে। মানুষ যখন তার উপভোগ্য কাজগুলো করে এবং কাজে অত্যন্ত মনোযোগী হয়, তখন তারা কম বাধ্যতামূলক দায়িত্বগুলি এড়িয়ে যায়। তারা পছন্দের কাজগুলোতে এতটাই মগ্ন হয়ে পড়ে যে তারা সময়ের ট্র্যাক বা তাদের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা হারিয়ে ফেলে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

গবেষকরা পরামর্শ দেন যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দীর্ঘসূত্রতা বিশেষভাবে লক্ষণীয় হতে পারে। সাইকোলজিক্যাল বুলেটিন ২০০৭-এ  প্রকাশিত একটি মেটা বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, ৮০% থেকে ৯৫% কলেজ ছাত্র নিয়মিতভাবে দীর্ঘসূতার শিকার হয়, বিশেষ করে যখন এটি অ্যাসাইনমেন্ট এবং কোর্সওয়ার্ক সম্পূর্ণ করার ক্ষেত্রে আসে।

বর্তমান প্রেক্ষাপট

বর্তমান প্রেক্ষপটে মানুষের আচরণে ‌‘দীর্ঘসূত্রতা’ বিশেষভাবে পরিলক্ষিত একটি বিষয়  হতে পারে। এর কারণ হতে পারে, আমরা দীর্ঘমেয়াদী ফলাফলের তুলনায় তাৎক্ষণিক তৃপ্তি বা পুরষ্কার দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়ার প্রবণতা রাখি। এই কারণেই এটি দীর্ঘসূত্রতার মুহুর্তেও ভাল লাগে। উদাহরণস্বরূপ, বিছানায় থাকা এবং টিভি দেখার তাত্ক্ষণিক পুরষ্কার একটি ব্লগ পোস্ট প্রকাশ করার দীর্ঘমেয়াদী পুরষ্কারের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়, যা সম্পাদন করতে অনেক বেশি সময় লাগে। তাই বর্তমান প্রজন্মের মাঝে দীর্ঘসূত্রতার লক্ষণগুলো বিশেষভাবে প্রকট।