দুই সপ্তাহেও উদ্ধার হয়নি দুই প্রবাসীর সোনা, বিমানের গড়িমসি
শাহজালাল বিমানবন্দর
প্রথম নিউজ, ঢাকা: ঘটনা গত ১৫ অক্টোবরের। সিঙ্গাপুর থেকে ছেড়ে আসা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে ঢাকা ফেরেন প্রবাসীসহ চার যাত্রী। চাঙ্গি বিমানবন্দরে তাদের হ্যান্ড লাগেজ ভারী হওয়ায় চেক-ইনে দেওয়া হয়। ঢাকার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণের পর লাগেজ বেল্টে এসে ঘটে বিপত্তি। চার যাত্রী তাদের ব্যাগ ড্যামেজ ও খোলা অবস্থায় পান। পরে দেখতে পান ব্যাগে থাকা স্বর্ণালংকার ও মোবাইল ফোনসহ নেই মূল্যবান কোনো জিনিস।
১৫ দিন পার হলেও এ ঘটনায় কে বা কারা জড়িত তা এখন পর্যন্ত খুঁজে বের করতে পারেনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ। ভুক্তভোগী চারজনের মধ্যে দুই প্রবাসী যাত্রী বিমানবন্দর থানায় মামলা করলেও তদন্তে নেই কোনো অগ্রগতি। সিঙ্গাপুর ও ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা থাকার পরও কেন এ ঘটনার জট খুলছে না, তার সদুত্তর দিতে পারছে না কেউ। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, থানায় মামলা করার পর এখন পর্যন্ত কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। মালামাল উদ্ধার তৎপরতা কতদূর এগিয়েছে, তাও কেউ কিছু বলছে না। শুধু বিমান ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা এ ঘটনা তদন্ত করছে। কিন্তু কবে চুরি রহস্যের জট খুলবে, তা কেউ বলছে না।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট থেকে যাত্রীদের মালামাল চুরির ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও গত বছরের সেপ্টেম্বরে নেপাল থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় আসা নারী ফুটবল দলের একাধিক খেলোয়াড়ের ব্যাগ থেকে টাকা ও মূল্যবান জিনিসপত্র চুরির ঘটনা ঘটে। সে সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল ঢাকায় চুরি হয়নি। তখন ওই চুরির ঘটনায় কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি বিমান।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সূত্র জানায়, গত ১৫ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টা ১১ মিনিটের দিকে ঢাকায় আসে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিজি ৫৮৫। সিঙ্গাপুর থেকে আসা এই ফ্লাইটের যাত্রীদের মধ্য থেকে চারজন অভিযোগ করেন, বেল্ট থেকে সংগ্রহের পর তারা লাগেজ খোলা দেখতে পান। এর মধ্যে যাত্রী মোহাম্মদ ফখর উদ্দিনের ব্যাগটি পুরো খোলা ও লাগেজ বেল্টে ড্যামেজ অবস্থায় পাওয়া যায়। যাত্রী বাসুদেব দাসের ব্যাগটিও পুরো খোলা অবস্থায় পাওয়া যায়।
আরেক যাত্রী শিশির সরকারের ব্যাগের তালা ভাঙা ও খোলা অবস্থায় ছিল। পরে বিমানবন্দরে থাকা অবস্থায় তারা তাদের লাগেজ চেক করে দেখেন, ব্যাগে রাখা স্বর্ণালংকার ও মোবাইলসহ মূল্যবান জিনিসপত্র নেই। ব্যাগের ভেতরে স্বর্ণালংকার না পেয়ে শিশির সরকার নামে আরেক সিঙ্গাপুর প্রবাসী বিমানবন্দরের মেঝেতে গড়াগড়ি যান এবং কান্নাকাটি করতে থাকেন। তার সেই কান্নার দৃশ্য ভিডিও করে অন্য যাত্রীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করেন, যা দেশ-বিদেশে নিন্দার ঝড় তোলে।
পরে গত ১৭ অক্টোবর ভুক্তভোগী চার যাত্রীর মধ্যে দুজন মোহাম্মদ ফখর উদ্দিন ও শিশির সরকার বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন। মামলার এজাহারে শিশির সরকার অভিযোগ করেন, তার ব্যাগের ভেতরে একটি বক্সে ৭০ গ্রাম স্বর্ণালংকার ছিল। এর মধ্যে আটটি কানের দুল, দুটি চেইন, একটি নেকলেস ও একটি ব্রেসলেট। এসব গহনার আনুমানিক বাজারমূল্য ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। প্রবাসী মোহাম্মদ ফখর উদ্দিনের অভিযোগ, তার ব্যাগের ভেতরে একটি বক্সে সোনার দুটি কানের দুল ও একটি সোনার চেইন ছিল- যার ওজন ৩২ গ্রাম। এছাড়া একই ব্যাগে দুটি রেডমি নোট-১২ মডেলের মোবাইল ফোন ছিল। বিমানবন্দরে তিনি ব্যাগের চেইন ও তালা খোলা অবস্থায় দেখতে পান। এরপর ব্যাগ চেক করে দেখেন স্বর্ণালংকার ও মোবাইল ফোন নেই। তার স্বর্ণালংকারের বাজারমূল্য তিন লাখ টাকা। মোবাইল দুটির দাম ৩৪ হাজার টাকা।
জানতে চাইলে শিশির সরকার জাগো নিউজকে জানান, সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরে তারা যথাযথভাবে চেক-ইন সম্পন্ন করেন। তবে ফ্লাইটে ওঠার সময় বিমানে কর্মরত সিঙ্গাপুরের স্থানীয় কর্মীরা (চীনা ও ভারতীয়) বলেন, আপনাদের হাত ব্যাগ বড়, আপনারা ওই ব্যাগগুলো নিয়ে ফ্লাইটে উঠতে পারবেন না। চেক-ইন লাগেজ হিসেবে দিতে হবে। পরে ওই ব্যাগগুলোতে ট্যাগ লাগিয়ে যাত্রীদের লাগেজ ট্যাগ দেওয়া হয়। যাত্রীদের জানানো হয়, ঢাকায় গিয়ে লাগেজ বেল্টে তারা এ ব্যাগগুলো পাবেন। কিন্তু ঢাকায় নেমে আর মালামালগুলো পাইনি।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, নিয়ম অনুযায়ী কেবিন ব্যাগেজ সাত কেজির মধ্যে হতে হবে। কিন্তু ওই চার যাত্রীর লাগেজ সাত কেজির বেশি ছিল বলে জানতে পেরেছি। তাই সেগুলো লাগেজ হোল্ডে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মালামাল কীভাবে চুরি হলো, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে বিমান। তবে তদন্তে বিমানের কর্মীদের দায় থাকার সম্ভাবনা বেশি। তাই তদন্তে গাফিলতি করছেন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও বিমানের সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে জানতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তাহেরা খন্দকারের কাছে মালামাল উদ্ধার সম্পর্কে জানতে চাইলেও তিনি কোনো আপডেট তথ্য জানাতে পারেননি।
তবে গত ১৬ অক্টোবর লাগেজ বেল্টে চার যাত্রীর লাগেজ খোলা অবস্থায় পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম। তিনি জানান, র্যাম্প সিকিউরিটি সদস্যরা বিমান অবতরণের পরে লাগেজ খোলা অবস্থায় পাওয়া গেছে বলে জানায়। পরে যাত্রীরা লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে ঘটেছে কি না বিষয়টি নিখুঁতভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাহজালাল বিমানবন্দরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি ও বাংলাদেশের শাহজালাল বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা রয়েছে। এখন ফুটেজ ও সংশ্লিষ্টদের নজরদারির আওতায় আনলে রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব। চুরির ঘটনা প্রমাণ হলে বিধি মোতাবেক যাত্রীদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বিমানকে।
মামলার অগ্রগতি নেই: ভুক্তভোগী ওই চার যাত্রীর মধ্যে দুজন (মোহাম্মদ ফখর উদ্দিন ও শিশির সরকার) গত ১৭ অক্টোবর বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন। মামলা নম্বর ৩৪। কিন্তু মামলার দুই সপ্তাহ পরও তদন্ত শুরু করতে পারেনি পুলিশ। অথচ কয়েকদিন পরপরই থানায় কল দিয়ে মালামাল উদ্ধারের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদ ফখর উদ্দিন ও শিশির সরকার। বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল হক মিয়া জানান, থানায় মামলার পরপরই তারা শাহজালাল বিমানবন্দর ও চাঙ্গি বিমানবন্দরের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ চেয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে আবেদন করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা কেউ ফুটেজ দেয়নি। ফলে তদন্তকাজও শুরু করা যায়নি।