জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে ফের ছিনতাই, হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ
৫০ থানায় পুলিশের বিশেষ টিম
প্রথম নিউজ, ঢাকা: স্বাভাবিক সময়ই ঢাকা শহরে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ থাকেন রাজধানীবাসী। এর ওপর ঈদের ছুটির চারদিনে ঢাকার সড়ক ছিল তুলনামূলক নির্জন। ফাঁকা ঢাকায় রাতে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে ছিনতাইকারীরা। এছাড়া ছুটি শেষে ঢাকায় ফেরা মানুষকেও টার্গেট করে তারা। ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে পুলিশ কনস্টেবল নিহতের পর নড়েচড়ে বসে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। নগরকে ছিনতাইকারীমুক্ত করতে শুরু করে সাঁড়াশি অভিযান।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিশেষ অভিযানের জন্য ৫০টি থানায় বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। থানাগুলোতে গঠন করা হয়েছে ছিনতাই প্রতিরোধী বিশেষ টিম। অনেক থানায় আবার কুইক রেসপন্স টিমকে ছিনতাইবিরোধী অভিযানে যুক্ত করা হয়েছে। অতীতে যারা ছিনতাইয়ে জড়িয়েছে, তাদের তালিকা ধরে চলছে অনুসন্ধান। বাড়ানো হয়েছে টহল ডিউটি।খোদ ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক ঈদের দুদিন আগে রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনালে ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের জানান, এসব অপরাধী যেন জামিন না পায়, ঈদের সময় ফাঁকা ঢাকা নিরাপদ রাখতে সে ব্যাপারে চেষ্টা করা হবে।
এরই মধ্যে ঈদের পর গত ১৪ দিনে রাজধানী ঢাকায় ৬৭৯ ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় ৩০৮টি মামলা করা হয়।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, রাত গভীর হলে যানবাহন ও মানুষের সমাগম কমে গেলে ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে পড়ে। তখন বেশ কিছু এলাকায় রিকশা ও হেঁটে চলাচলকারীদের জন্য এটি বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দেশীয় অস্ত্রধারী ও দলবদ্ধ এসব ছিনতাইকারীর সঙ্গে প্রতিবাদ করাও কঠিন। একটু বলপ্রয়োগ করতে গেলে প্রাণে মেরে ফেলার ভয় থাকে। ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে প্রায়ই হতাহতের ঘটনা ঘটছে। বাস কিংবা ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে ওত পেতে মোবাইল টান দিয়েও দৌড়ে পালাচ্ছে ছিনতাইকারীরা।
ঈদের ছুটি শেষে গ্রামের বাড়ি শেরপুর থেকে ট্রেনে তেজগাঁও রেলস্টেশনে ফেরেন পুলিশ কনস্টেবল মনিরুজ্জামান তালুকদার (৪০)। গত ১ জুলাই ভোরে পায়ে হেঁটে ফার্মগেটের সেজান পয়েন্টের সামনে যাওয়া মাত্রই একদল ছিনতাইকারী মনিরুজ্জামানকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে। হত্যার পর তার কাছে থাকা মালামাল ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনায় সেদিন রাতেই চারজনকে গ্রেফতার করা হলে তাদের একজন হত্যার কথা স্বীকার করে। ছিনতাইয়ের সময় হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত চাকু ও ছিনতাই করা মোবাইল ফোনটি পরে উদ্ধার করে পুলিশ।
গত ২৯ জুন রাতে হাতিরঝিল এলাকায় ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের দুজন সাংবাদিক ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। তাদের মধ্যে প্রযোজক রাকিবুল হাসান রানা ছিনতাইকারীর হাতে গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হন। ছিনতাইকারীরা রানার হাতে থাকা ব্যাগটি নিয়ে যায়। এ ঘটনায় হাতিরঝিল থানায় মামলা হয়। পরে অভিযুক্ত দুই ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহৃত ছুরি ও একটি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত আরেক ছিনতাইকারীকে ধরতে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।
রাজধানীতে এমন ঘটনা শুধু সন্ধ্যা বা রাত নয়, এখন দিনদুপুরেও ঘটছে। সশস্ত্র ছিনতাইকারী চক্র ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহার করছে মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার কিংবা মোটরসাইকেল। এদের টার্গেট ভ্যানিটি ব্যাগ, হাতব্যাগ, স্বর্ণালংকার ও মোবাইল ফোনসেট। ছিনতাইকারীরা সাধারণত মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত তৎপর থাকে। তারা ভোরে বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চ টার্মিনাল ও রেলস্টেশন থেকে বাসামুখী রিকশাযাত্রী অথবা বাসা থেকে স্টেশনমুখী যাত্রীদের লক্ষ্যবস্তু বানায়।
ডিএমপি সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীর ফার্মগেটে পুলিশ কনস্টেবল মনিরুজ্জামান তালুকদারকে খুন করাসহ সাম্প্রতিক ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো যারা ঘটিয়েছে, তাদের প্রায় সবাই জামিনপ্রাপ্ত। পুলিশ সদস্য নিহতের ঘটনায় জড়িত এমন একজন আছেন, যিনি ছিনতাইয়ের অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে ৮ বার জেল খেটেছেন। এরমধ্যে ১৫ দিন, এক মাস থেকে শুরু করে একবার সর্বোচ্চ ২৬ মাস তিনি জেলে ছিলেন। এছাড়া ইনডিপেনডেন্ট টিভির সহকারী প্রযোজক রাকিবুল হাসান রানাকে ছুরিকাহত করা ছিনতাইকারীও জামিনে বেরিয়ে অপরাধে জড়িয়েছেন।
এদিকে রাজধানীর থানাগুলোর বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের মামলা না নেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ছিনতাইয়ের মামলা করতে গেলে ‘হারানোর জিডি’ নেওয়ার অভিযোগ আছে অনেক থানার বিরুদ্ধে। তবে সম্প্রতি ছিনতাই বেড়ে যাওয়ায় থানার ওসিদের এ বিষয়েও সতর্ক করা হয়েছে। ছিনতাইয়ের অভিযোগগুলো নিয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে। মূলত ডিএমপি সদর দপ্তরের এমন কঠোর অবস্থানের কারণেই গত কয়েকদিনে এত ছিনতাইকারী গ্রেফতার হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
ডিএমপির কয়েকটি থানার ওসিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছিনতাইয়ের অভিযোগে যেসব আসামিকে গ্রেফতার করা হয় তারা পুনরায় কারাগার থেকে বেরিয়ে ফের ছিনতাইয়ে নেমে পড়েন। এ কারণে গ্রেফতার হলেও ছিনতাইকারীদের ভয় খুব বেশি থাকে না। তারা মনে করেন, কিছুদিন কারাগারে থেকে জামিনে বেরিয়ে ফের ‘কাজে নামতে’ পারবেন।
ছিনতাই ঠেকাতে ‘এসআইভিএস’
ডিএমপির একটি সূত্র জানায়, সাসপেক্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম (এসআইভিএস) নামের একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ে জড়িত ৬ হাজার ১৯৮ জনের ছবিসহ নাম, বয়স, বাবার নাম, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা, আঙুলের ছাপ, গ্রেফতারের তারিখ, তাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা, গ্রেফতারকারী কর্মকর্তার নাম-পদবি ও মোবাইল ফোন নম্বর লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়া চলমান। অপরাধীদের সংখ্যা আরও বাড়বে।
যেভাবে কাজে লাগছে এসআইভিএস
বর্তমানে রাজধানীর অনেক ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের রহস্যের জট খুলতে এই তথ্যভান্ডারকে কাজে লাগানো হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। উদাহরণ হিসেবে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) হায়াতুল ইসলাম খান জাগো নিউজকে জানান, গত ১২ মে ভোরে একটি ডাকাত দলের কবলে পড়েন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) নারী কনস্টেবল নার্গিস আক্তার (৩৩)। রিকশা থামিয়ে তার কাছ থেকে সোনার চেইন, নগদ টাকা ও মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে যায় ডাকাতরা। একই রাতে ধানমন্ডিতে আরেকটি ডাকাতি করে একই চক্র। পরদিন ১৩ মে তেজগাঁও ও বনানী থানা এলাকায় আরও দুটি ডাকাতি করে তারা। ডাকাতির ঘটনায় পল্টন থানায় মামলা করেন নার্গিস আক্তার। তদন্ত করতে গিয়ে সিসি ক্যামেরার শতাধিক ফুটেজ থেকে ডাকাত চক্রকে চিহ্নিত করা হয়। পরে এসআইভিএসের সঙ্গে ছবি মিলিয়ে তাদের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে ১৫ মে মহাখালী থেকে ডাকাত দলের চারজনকে গ্রেফতার করে পল্টন থানা পুলিশ।
এর আগে গত বছরের ২৭ মার্চ ভোরে মিরপুরের শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন দন্তচিকিৎসক আহমেদ মাহী (৩৯)। এ ঘটনায় ডিএমপির গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) পাঁচজনকে গ্রেফতার করে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি ও ছিনতাই হওয়া মোবাইলটি উদ্ধার করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, গ্রেফতার ব্যক্তিদের মধ্যে দুজনের নাম এসআইভিএসে ছিল। এ তথ্যভান্ডারের কারণে রাজধানীতে ছিনতাই ও ডাকাতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে দাবি করেছেন ডিএমপির কর্মকর্তারা।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ড. খ. মহিদ উদ্দিন (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) বলেন, এসআইভিএসকে কাজে লাগিয়ে গত বছরের ঈদুল ফিতরের আগ পর্যন্ত তিন মাসে ছিনতাই, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত সন্দেহে ১ হাজার ৭৯৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, ছিনতাই রোধে থানা পুলিশ, ডিবি ও থানার বিশেষ টিম কাজ করছে। ঈদের পর গত ১৪ দিনে রাজধানী ঢাকায় ৬৭৯ ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করা হয়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় ৩০৮টি মামলা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে চলা বিশেষ অভিযানে ১ থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত ৬৭৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৪৪ জনকে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া ডিএমপির মিরপুর বিভাগ ১০৪ জন, লালবাগ বিভাগ ৮৬ জন, রমনা বিভাগ ৫০ জন, মতিঝিল বিভাগ ৬৩ জন, উত্তরা বিভাগ ৬৯ জন, গুলশান বিভাগ ৩৩ জন ও ওয়ারী বিভাগ ৩০ জনকে গ্রেফতার করেছে।
গ্রেফতার ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে ৩০৮টি মামলা হয়েছে জানিয়ে ডিসি ফারুক হোসেন বলেন, সবচেয়ে বেশি তেজগাঁও বিভাগের সংশ্লিষ্ট থানায় ১০৪টি মামলা হয়েছে। এছাড়া রমনা বিভাগে ২৫টি, লালবাগ বিভাগে ৫৫টি, মতিঝিল বিভাগে ২৬টি, ওয়ারী বিভাগে ১৫টি, মিরপুর বিভাগে ৫০টি, গুলশান বিভাগে ১৭টি ও উত্তরা বিভাগের সংশ্লিষ্ট থানায় ১৬টি মামলা হয়েছে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ বিষয়ে বলেন, ঈদ পরবর্তী দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক। ঈদের ছুটি শেষে ঢাকামুখী মানুষের যাতায়াতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশব্যাপী নিরাপত্তা প্রদানের লক্ষ্যে র্যাব তৎপর হয়। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও সোশ্যাল মিডিয়ায় লক্ষ্য করা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাইয়ের প্রবণতা বেড়েছে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে থানায় একাধিক জিডি ও মামলা রুজু হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব চলমান নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকায় নিরাপত্তা বাড়িছে। তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে নিরাপত্তা প্রদানের অংশ হিসেবে র্যাব প্রত্যেক এলাকায় দুটি শিফটে বিশেষ রোবাস্ট পেট্রোলের মাধ্যমে পর্যাপ্ত টহল ও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্যদের ডিউটিতে মোতায়েন করা হয়। গ্রেফতার করা হয় অসংখ্য ছিনতাইকারীকে।