গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিষয়ে নিশ্চিত হতে চায় ইইউ
তাদের মতামতের ওপর নির্ভর করবে সংস্থাটির পর্যবেক্ষক দল নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আসবে কিনা।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: বাংলাদেশ সফরের দ্বিতীয় দিন সোমবার ধারাবাহিক বৈঠকের মধ্য দিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল। গত দুই দিনের বৈঠকগুলোতে প্রাধান্য পেয়েছে নির্বাচন প্রক্রিয়া, নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। ইইউ প্রতিনিধি দল নিশ্চিত হতে চায় দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও সহিংসতামুক্ত পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে। তাদের মতামতের ওপর নির্ভর করবে সংস্থাটির পর্যবেক্ষক দল নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আসবে কিনা।
গতকাল দিনের শুরুতে ইইউ প্রতিনিধি দল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন অনুবিভাগের মিশন মহাপরিদর্শক (আইজিএম) আসাদ আলম সিয়ামের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অংশ নেন। ইইউ প্রতিনিধি দলের প্রধান ইওনাউ দিমিত্রার নেতৃত্বেও প্রতিনিধি দল বৈঠকে অংশ নেয়। এ সময় ইইউর ঢাকা দূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন।
বেলা ১১টার দিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে ইইউ প্রতিনিধি দল। এতে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে কমিশনের অন্যান্য কর্মকর্তা অংশ নেন। দুপুরে ইইউ প্রতিনিধি দলটি পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যায়। সেখানে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে কর্মকর্তারা ইইউ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর পর মধ্যাহ্নভোজের বিরতি দিয়ে ইইউ প্রতিনিধি দলটি পুলিশ সদরদপ্তরে এ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে পুলিশের অন্যান্য কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। বিকেলে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মতবিনিময় করে ইইউ প্রতিনিধি দলটি।
নাম না প্রকাশের শর্তে এক কূটনীতিক বলেন, ভোটের দিন এবং আগের তিন মাসকে নির্বাচনের সময় হিসেবে দেখে না পশ্চিমারা। তারা বেশ লম্বা সময়কে নির্বাচনকাল হিসেবে বিবেচনা করে। যাতে নির্বাচনের বছর এবং তার পরের কয়েক মাস যুক্ত। ফলে নির্বাচনী পরিবেশ বলতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বিরোধী দলগুলোর সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা, ভোটদান প্রক্রিয়াতে নাগরিক সমাজের স্থানসহ সার্বিক মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো যুক্ত। তারা পর্যবেক্ষণ করছেন, সরকার কীভাবে বিরোধীদের সঙ্গে আচরণ করছে এবং নাগরিক অধিকার সুসংহত রেখেছে। এ বিষয়গুলো তাদের প্রতিবেদনে উঠে আসবে।
সকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচনে পর্যবেক্ষকদের ভিসাসংক্রান্ত বিষয় জানতে চেয়েছে প্রতিনিধি দলটি। সেইসঙ্গে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর জন্য আমন্ত্রণপত্র ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নির্বাচনকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হয়ে কাজ করে। ফলে আগামী নির্বাচনে নির্বাচন পর্যবেক্ষক আমন্ত্রণের বিষয়ে সবুজসংকেত রয়েছে সরকার ও ইসির পক্ষ থেকে। ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী আমন্ত্রণ পাঠানো থেকে শুরু করে অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার দায়িত্ব পালনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আন্তরিক থাকবে বলে ইইউ প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়।
মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে দেশে নির্বাচনের পরিবেশ এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছে ইইউ প্রতিনিধি দল। প্রতিনিধি দল জানতে চেয়েছে আগের চেয়ে নির্বাচনী পরিবেশ কোনো উন্নতি হয়েছে কিনা।
কমিশন জানায়, সাম্প্রতিক সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরিবেশের যথেষ্ট উন্নতি দেখা গেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্বাচনী সহিংসতা কম হয়েছে।
বৈঠক শেষে কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। সফররত প্রতিনিধি দল আরও জানতে চেয়েছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কীভাবে ও কোন প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে। জবাবে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন জানিয়েছেন, নির্বাচনের আগে বিভাগীয় পর্যায়ে বিভিন্ন জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে কমিশন আলাদাভাবে বসবে। সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে সরকার আন্তরিকভাবে সচেষ্ট। চেয়ারম্যান প্রতিনিধি দলকে আরও জানান, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে কমিশন যথেষ্ট সচেতন।
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচনের আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অবস্থান করার আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে ইইউ প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে। সেই সঙ্গে এ বৈঠকে নিরাপত্তার বিষয়টি আলোচনায় আসে। বৈঠকে ইইউ প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়, ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী সব সহযোগিতা ইইউ পর্যবেক্ষকদের দেওয়া হবে।
বৈঠক শেষে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আমিনুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, তারা আমাদের কাছে সহায়তা চাচ্ছে। আমরা বলেছি, সব ধরনের সহায়তা দেব। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় যাওয়ার বিষয়ে বলেছে। এ বিষয়টি দেখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়; আমরাও দেখি। আমাদের দিক থেকে সব সহযোগিতা দেওয়ার বিষয়ে বলেছি। নির্বাচনের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সুতরাং তাদের থাকা, পরিদর্শন করা বা চলাচল করার ক্ষেত্রে সব ধরনের সহায়তা আমরা দেব।
আমিনুল ইসলাম বলেন, তারা নির্বাচনের আগে ছয় সপ্তাহ পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় পর্যবেক্ষক রাখতে চায়। তারা নির্বাচনের সময় আসবে। আমরা বলেছি, সেটি নির্বাচন কমিশন দেখবে। আমাদের দিক থেকে অনুরোধ করেছি, এগুলো বিশেষ তিনটি জেলা; সেখানে কিছু নিরাপত্তার ইস্যু আছে। তবে এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো পরিবেশ। তারা খুবই সন্তুষ্ট।
নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে আসা ইইউর ৬ সদস্যের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল ২৩ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করবে। আগামী ১৫ জুলাই বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করবে তারা। এ দলটির মূল কাজ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশনের কর্মপরিধি, পরিকল্পনা, বাজেট, লজিস্টিকস ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো মূল্যায়ন করা।
পুলিশের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা প্রসঙ্গ
বিকেলে পুলিশ সদরদপ্তরে যান প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) কামরুল আহসানের সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। এতে ডিআইজি (অপারেশন) আনোয়ার হোসেন, ডিআইজি হায়দার আলী খানসহ পুলিশের আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা পরিকল্পনায় কী কী বিষয় যুক্ত থাকে, সে ব্যাপারে জানতে চেয়েছে ইইউর পর্যবেক্ষক দল। নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিষয়েও জানতে চাওয়া হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অনুসারে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেয় প্রশাসন। স্ট্রাইকিং ফোর্স ও মোবাইল টিমও দায়িত্ব পালন করে। প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়তি ফোর্স মোতায়েন করা হয়। প্রচলিত আইন ও বিধিবিধানের আওতায় থেকে দায়িত্ব পালন করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া একটি আচরণ বিধিমালা রয়েছে। সেদিকেও খেয়াল রাখা হয়।
বৈঠকে উপস্থিত ডিআইজি (অপারেশন) আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মানবাধিকার বা নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিষয়ে ইইউ আমাদের কোনো পরামর্শ দেয়নি। তারা আমাদের কাছে শুনেছে।’
আ’লীগ প্রতিনিধিদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক
প্রতিনিধি দলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্যরা। বিকেলে রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরে ইইউর রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলির বাসভবনে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে আওয়ামী লীগের চার সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির এবং আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ও উপকমিটির সদস্য সচিব ড. শাম্মী আহম্মেদ।
বৈঠক শেষে শাম্মী আহম্মেদ সাংবাদিকদের বলেন, আসলে এটি ছিল একটি অনানুষ্ঠানিক বিষয়। পরিচিতিমূলক সাক্ষাতের মতো। আগামী ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে ইইউ প্রতিনিধি দলের বৈঠক হবে। তিনি বলেন, ‘ওই বৈঠকে নেতৃত্ব দেবেন আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আমরা বলেছি, তারা (ইইউ) চাইলে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারেন।’