করোনায় তুলনামূলক পিছিয়ে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা: গবেষণা প্রতিবেদন

চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণির ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীদের ওপর এর প্রভাব বেশ পড়েছে। বর্তমানে তারা ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে।

করোনায় তুলনামূলক পিছিয়ে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা: গবেষণা প্রতিবেদন

প্রথম নিউজ, ঢাকা: করোনা মহামারির কারণে ১৮ মাস বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে করে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের অনেকে বাংলা, গণিত, ইংরেজি ও বাংলাদেশ ও বিশ্ব-পরিচয় বিষয়গুলোর আগের পড়াশোনা ভুলে গেছে। কারো কারো স্মরণ রাখার ক্ষমতা কমে গেছে। চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণির ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীদের ওপর এর প্রভাব বেশ পড়েছে। বর্তমানে তারা ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে।

করোনায় শিখন ঘাটতি ও তার প্রতিকার সংক্রান্ত জাতীয় পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাক্রমের (এনসিটিবি) এক গবেষণায় এমন চিত্র উঠে এসেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সহযোগিতায় এ গবেষণাটি পরিচালিনা করা হয়েছে। এ জন্য দেশের ১০টি উপজেলা/থানার তিনটি করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট ১৮ হাজার ৮৩৮ জন শিক্ষার্থীর ওপর নিরীক্ষা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সোমবার (১৫ মে) এ প্রতিবেদন প্রকাশের কথা রয়েছে বলে জানা গেছে।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, করোনার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দূর শিখন, অনলাইন ক্লাস, ডিভাইজসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ক্লাস পরিচালিত হলেও ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী যুক্ত ছিল। নানা প্রতিবন্ধকতায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী এ সুবিধার বাইরে ছিল। তারা কখনো এসব ক্লাসে যুক্ত হয়নি। শহরের চাইতে গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষার্থী এ আওতার বাইরে ছিল। ফলে তাদের অধিকাংশের শিখন ঘাটতি হয়েছে।

শিখন ঘাটতি: প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা চরমভাবে পিছিয়ে রয়েছে। শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ সব বিষয়ে (বাংলা, গণিত এবং ইংরেজি) বর্তমান ও আগের শ্রেণির শিক্ষাক্রমে চরম এবং মধ্যম মাত্রার শিখন ঘাটতিতে ভুগছে। তার মধ্যে বাংলায় ৩৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ, ইংরেজিতে ৩১ দশমিক ০৯ শতাংশ এবং গণিতে ৭৮ দশমিক ২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে বাংলায় ৪২ দশমিক ৭২ শতাংশ, গণিতে ৪১ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং ইংরেজিতে ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ। তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় ৩৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ, ইংরেজিতে ৩৫ দশমিক ২৮ শতাংশ, গণিতে ৩৯ দশমিক ৭১ শতাংশ, বিজ্ঞানে ৪৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব-পরিচয় বিষয়ে ৩৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

দেখা গেছে, চতুর্থ শ্রেণিতে বাংলায় ৪৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ, ইংরেজিতে ৪৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ, গণিতে ৩৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ, বিজ্ঞানে ৩৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব-পরিচয় বিষয়ে ৪৩ দশমিক ১৪ শতাংশ। পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলায় ৩৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ইংরেজিতে ৪৭ শতাংশ ৬৮ শতাংশ, গণিতে ৪২ দশমিক ৯২ শতাংশ, বিজ্ঞানে ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব-পরিচয় বিষয়ে ৩৯ দশমিক ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী পিছিয়ে রয়েছে।

জেলা ও স্থান-ভিত্তিক পিছিয়ে পড়ার চিত্র: বরিশাল বিভাগের শিক্ষার্থীরা সব শ্রেণি ও বিষয়ে অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে সিলেট বিভাগের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। সব বিভাগের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা, গণিত, ইংরেজি বিষয়ের ফলাফলে তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য বিদ্যমান। দ্বিতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা শহরের শিক্ষার্থীদের চেয়ে তুলনামূলক ভালো ফলাফল করেছে।

অন্যদিকে, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে শহরের শিক্ষার্থীরা অল্প ব্যবধানে গ্রামের শিক্ষার্থীদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। সব বিষয় ও শ্রেণিতে সমতল অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা পাহাড়ি অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের চেয়ে ভালো ফলাফল করেছে। ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা সমতল অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের চেয়ে পিছিয়ে আছে।

দূর শিখনে অংশগ্রহণ: চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শতকরা প্রায় ৭০ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থী কখনই টেলিভিশনের সম্প্রচারিত দূর শিখন কার্যক্রমে অংশ নেয়নি। ৭৬ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী মোবাইল এবং ৮৪ দশমিক ২ ভাগ শিক্ষার্থী কখনই রেডিও’র মাধ্যমে দূর শিখন কার্যক্রমে অংশ নেয়নি। যেসব শিক্ষার্থী নিয়মিত বা মাঝেমধ্যে দূর শিখন কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। তাদের ফলাফল তুলনামূলক ভালো। যেসব শিক্ষার্থী মাঝেমধ্যে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ক্লাসগুলোতে অংশ নিয়েছিল তাদের ফলাফল যারা কখনই অংশ নেয়নি তাদের চেয়ে অনেকাংশে ভালো।

ঘাটতি কাটাতে চার সুপারিশ: ১. করোনায় শিখন ঘাটতি হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য একটি চাহিদা-ভিত্তিক ও বাস্তবায়নযোগ্য ‘প্রতিকারমূলক শিখন প্যাকেজ’ তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে সুপারিশ করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত পরিকল্পনা তৈরি এবং তা বাস্তবায়ন কর্মকাণ্ডে অগ্রাধিকার দিতে হবে বাংলা, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ের আবশ্যকীয় শিখন যোগ্যতা। এক্ষেত্রে ২০২০ এবং ২০২১ সালে যেসব শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল তাদের পুরো প্রাথমিক শিক্ষা জীবনকে অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়েছে।

২. প্রতিকারমূলক শিখন প্যাকেজ বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকদের নতুন শিখন-শেখানো পদ্ধতি ও কৌশলের ওপর প্রশিক্ষণ জরুরি। এজন্য একটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল তৈরি করে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করতে হবে।

৩. করোনাকালীন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এরই মধ্যে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে। তাদের শিখন-ক্ষতি ও শিখন-ঘাটতির বিষয়টি বিবেচনা করে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্যও এরূপ একটি গবেষণা পরিচালনা এবং তথ্যভিত্তিক প্রতিকারমূলক শিখন কার্যক্রম নেওয়া যেতে পারে।

৪. শিখন পুনরুদ্ধার কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরও ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি চিহ্নিতকরণে বিদ্যালয়ভিত্তিক চলমান মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে চিহ্নিত শিখন ঘাটতি পূরণে প্রস্তুত করে প্রতিকারমূলক শিখন প্যাকেজ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।