সিমেন্টে বহুজাতিকের রমরমা ব্যবসা, ডলারে ‘ধরা’ দেশীয় প্রতিষ্ঠান

চলতি বছরের তিন মাসে বহুজাতিক দুটি কোম্পানির মধ্যে একটির মুনাফা বেড়েছে ১০২ শতাংশ।

সিমেন্টে বহুজাতিকের রমরমা ব্যবসা, ডলারে ‘ধরা’ দেশীয় প্রতিষ্ঠান

প্রথম নিউজ, ঢাকা: দেশের বাজারে সিমেন্টের ব্যবসা করা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে রমরমা ব্যবসা করেছে। বিক্রি বাড়ার পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর মুনাফায় বড় উন্নতি হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানির পাশাপাশি দেশীয় সিমেন্ট কোম্পানিরও বিক্রি বেড়েছে। তবে ডলারের বাড়তি দামের কারণে দেশীয় কোম্পানির মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

দেশে ব্যবসা করা সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মাত্র সাতটি। এর মধ্যে দুটি বহুজাতিক কোম্পানি। আর দেশীয় প্রতিষ্ঠান পাঁচটি। চলতি বছরের তিন মাসে বহুজাতিক দুটি কোম্পানির মধ্যে একটির মুনাফা বেড়েছে ১০২ শতাংশ। একটি গত বছর লোকসানে থাকলেও এবার বড় মুনাফা করেছে।

অপরদিকে দেশীয় পাঁচ সিমেন্ট কোম্পানির মধ্যে তিনটির মুনাফা গত বছরের তুলনায় কমেছে। বিপরীতে দুটির মুনাফা বেড়েছে। মুনাফা বাড়ার পাশাপাশি বহুজাতিক একটি কোম্পানিতে বিদেশি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ বেড়েছে। দেশীয় পাঁচ কোম্পানিতেই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বেড়েছে। তবে দেশীয় কোম্পানি পাঁচটির মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ আছে মাত্র দুটিতে। এর মধ্যে একটিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ বেড়েছে এবং একটিতে কমেছে।

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসের ব্যবসায় দেশীয় সিমেন্ট কোম্পানির মুনাফা কম হওয়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে সিমেন্টের বিক্রি ভালো হয়েছে। তবে ডলারের বাড়তি দামের কারণে মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কারণ সিমেন্টের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আনতে হয়। ডলারের বাড়তি দামের কারণে কাঁচামালের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বিক্রি বাড়ার পরও মুনাফায় প্রবৃদ্ধি কম।

দেশের বাজারে দাপটের সঙ্গে সিমেন্টের ব্যবসা করছে বহুজাতিক কোম্পানি লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ। চলতি বছরের তিন মাসের ব্যবসায় এই প্রতিষ্ঠানটি বড় ধরনের চমক দেখিয়েছে। জানুয়ারি থেকে মার্চ সময়ে কোম্পানিটি ৮৫৪ কোটি টাকার সিমেন্ট বিক্রি করেছে। গত বছরের একই সময়ে বিক্রি হয় ৬২৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিক্রি বেড়েছে ৩৭ শতাংশ।

বিক্রি যে হারে বেড়েছে কোম্পানিটির মুনাফা বেড়েছে তার থেকে বেশি হারে। কোম্পানিটির মুনাফা বেড়েছে ১০২ শতাংশ। তিন মাসের ব্যবসায় কোম্পানিটি করপূর্ববর্তী পরিচালন মুনাফা করেছে ২৪৩ কোটি টাকা। আর করপরবর্তী মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১৯০ কোটি টাকা। এতে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ১ টাকা ৬৪ পয়সা। গত বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা ৮১ পয়সা।

লাফার্জহোলসিমের থেকেও বড় চমক দেখিয়েছে আরেক বহুজাতিক কোম্পানি হাইডেলবার্গ সিমেন্ট। কোম্পানিটি চলতি বছরের তিন মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৬ টাকা ৮৫ পয়সা। গত বছরের প্রথম তিন মাসের ব্যবসায় কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ২ টাকা ৯৭ পয়সা লোকসান করে।

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসের ব্যবসায় বড় মুনাফা করার কারণ হিসেবে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী ইকবাল চৌধুরী বলেন, প্রথম প্রান্তিকের (২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ) ফলাফল আমাদের পণ্যের বৈচিত্র্য, উদ্ভাবনী পণ্য দ্বারা পরিচালিত কৌশলগত উপস্থিতি, গুণগতমানসম্পন্ন সমাধান, ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট এবং নতুন নতুন চ্যানেলের সমাহারে আমাদের সামর্থ্যের প্রতিফলন। তিনি বলেন, আমরা আমাদের জিওসাইকেল প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রাহকদের টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সেবা দিচ্ছি। বছরের শুরুটা হয়েছে রেকর্ড দিয়ে। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে এই প্রবৃদ্ধির ধারা টেকসই করতে ডিজিটাল ফুটপ্রিন্টের পাশাপাশি চ্যানেল বৃদ্ধি করা, অ্যাগ্রিগেটস ব্যবসা, নতুন পণ্য এবং সমাধানের ওপর জোর দেওয়া অব্যাহত রাখব।

তিনি আরও বলেন, বছরের বাকি সময় চ্যালেঞ্জিং হবে; কেননা ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকবে। এরপরও এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার মাধ্যমে সামনের প্রান্তিকগুলোতেও ভালো ফলাফল উপহার দেওয়ার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।

এদিকে দেশীয় সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর মধ্যে সব থেকে ভালো ব্যবসা করেছে কনফিডেন্স সিমেন্ট। কোম্পানিটি চলতি বছরের তিন মাসে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ১ টাকা ৮৪ পয়সা। এতে চলমান হিসাব বছরের নয় মাসে (২০২২ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত) শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ৬ টাকা ২৬ পয়সা। বড় মুনাফা করলেও আগের হিসাব বছরের তুলনায় প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা কমেছে। আগের হিসাব বছরের প্রথম নয় মাসে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করে ৮ টাকা ৪২ পয়সা।

মুনাফা কমার এ তালিকায় রয়েছে মেঘনা সিমেন্টও। ২০২২ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে এই কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৬৯ পয়সা, যা আগের হিসাব বছরের একই সময়ে ছিল ১ টাকা ৩৯ পয়সা। মুনাফা বাড়ার তালিকায় থাকা ক্রাউন সিমেন্ট ২০২২ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসের ব্যবসায় ২ টাকা ১৬ পয়সা মুনাফা করেছে। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয় ৯১ পয়সা। প্রিমিয়াম সিমেন্ট চলমান হিসাব বছরের নয় মাসে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৪৬ পয়সা, আগের হিসাব বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয় ৩৭ পয়সা।

তালিকাভুক্ত দেশীয় আরেকটি প্রতিষ্ঠান এরামিট সিমেন্ট লোকসানে নিমজ্জিত হয়েছে। এই কোম্পানিটি ২০২২ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ১১ টাকা ৬০ পয়সা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ৭ টাকা ৬২ পয়সা।

তালিকাভুক্ত দুই বহুজাতিক কোম্পানি মুনাফায় বড় চমক দেখালেও দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কেন পিছিয়ে জানতে চাইলে কনফিডেন্স সিমেন্টের কোম্পানি সচিব দেলোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, সিমেন্টের সবগুলো কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। আমাকে কাঁচামাল কিনতে হচ্ছে ডলারে। কিন্তু এখানে বিক্রি করতে হচ্ছে টাকায়। ডলারের রেট ফ্লাকচুয়েশন হওয়ায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঁচামালের খরচ বেড়ে গেছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ইন্টারন্যাশাল একটা চেইন থাকে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ইন্টারন্যাশনাল চেইন নেই। বহুজাতিক কোম্পানি এটার একটা সুবিধা পেতে পারে।

তিনি বলেন, সব থেকে বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ডেফার্ট এলসি (পণ্য আমদানিতে বাকিতে ঋণপত্র)। বহুজাতিক কোম্পানির ডেফার্ট এলসি নেই। আমাদের ডেফার্ট এলসি আছে। ডেফার্ট এলসিগুলো এখন ম্যাচিউরিটি হচ্ছে। ডলারের রেট ৮৫-৮৬ টাকা থাকার সময় অনেকগুলো এলসি বুক করা ছিল। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বৈশিক প্রেক্ষাপটে এসব এলসির ম্যাচিউরিটির সময় ডলারের রেট ১১২, ১১৩ টাকা হয়েছে। ডলারের রেটের এই ফ্লাকচুয়েশনের কারণে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাফার করতে হচ্ছে।

সিমেন্টের বিক্রি পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জানুয়ারি-মার্চ এই সময়টা সিমেন্টের ব্যবসার পিক টাইম। সিমেন্টের বিক্রি কিছুটা বেড়েছে। তবে ওইভাবে বাড়েনি। কারণ মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।

বিদেশি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের চিত্র: তালিকাভুক্ত চারটি সিমেন্ট কোম্পানিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশে বিদেশিদের বিনিয়োগ বেড়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল শেষে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের দশমিক ৭৮ শতাংশ রয়েছে বিদেশিদের কাছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে কোম্পানিটির দশমিক ৬৯ শতাংশ শেয়ার ছিল বিদেশিদের কাছে। বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি কোম্পানিটিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বেড়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কোম্পানিটির ১৫ দশমিক ৯১ শতাংশ শেয়ার ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে, সেটি এখন বেড়ে ১৭ দশমিক ৩২ শতাংশ হয়েছে।

আরেক বহুজাতিক কোম্পানি হাইডেলবার্গ সিমেন্টের দশমিক ২৭ শতাংশ শেয়ার আছে বিদেশিদের কাছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কোম্পানিটির দশমিক ৫৯ শতাংশ শেয়ার ছিল বিদেশিদের কাছে। অর্থাৎ এই কোম্পানিটিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ কমেছে। সেই সঙ্গে কমেছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কোম্পানিটির ২৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ শেয়ার ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে, এখন সেটা কমে ২৬ দশমিক ৯৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রিমিয়ার সিমেন্ট এবং ক্রাউন সিমেন্টে বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে। এর মধ্যে ক্রাউন সিমেন্টে বিদেশি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ উভয়ই কমেছে। ২০২২ সালের জুন শেষে ক্রাউন সিমেন্টের দশমিক ১০ শতংশ শেয়ার ছিল বিদেশিদের কাছে, এখন তা কমে দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ২০২২ সালের জুন শেষে প্রতিষ্ঠানটির ১৭ দশমিক ৭০ শতাংশ শেয়ার ছিল, এখন তা কমে ১৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ হয়েছে। তবে প্রিমিয়ার সিমেন্টে বিদেশি ও প্রাতিষ্ঠানিক উভয় বিনিয়োগ বেড়েছে। ২০২২ সালের জুনে কোম্পানিটির দশমিক শূন্য ৩ শতংশ শেয়ার ছিল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে। এখন তা বেড়ে দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ধারণ ২০ দশমিক ৮৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৩ দশমিক ৭০ শতাংশ হয়েছে।

বিদেশি বিনিয়োগ না থাকা বাকি তিন কোম্পানিতেই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বেড়েছে। এর মধ্যে মেঘনা সিমেন্টের ৩৩ দশমিক ৮২ শতাংশ শেয়ার আছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে। ২০২২ সালের জুনে ছিল ৩৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ। কনফিডেন্স সিমেন্টে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ধারণ ৩৫ দশমিক ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ হয়েছে। আর এরামিট সিমেন্টে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ধারণ ১০ দশমিক ৪৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ হয়েছে।