Ad0111

ওয়াসার দুর্নীতি-অপচয়ের দায় ভোক্তাদের ওপর চাপাতেই মূল্য বৃদ্ধি: ক্যাব

২ দফায় আবাসিকে প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম বেড়েছিল ৩ টাকা ৬১ পয়সা (৩১ শতাংশ) এবং বাণিজ্যিকে বেড়েছিল ৪ টাকা ৯৬ পয়সা (১৩ শতাংশ)।

ওয়াসার দুর্নীতি-অপচয়ের দায় ভোক্তাদের ওপর চাপাতেই মূল্য বৃদ্ধি: ক্যাব
ফাইল ফটো

প্রথম নিউজ, ঢাকা: ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান সংস্থাটির অমিতব্যয়িতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি-অপচয়ের সব দায়ভার ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে ভর্তুকি কমানোর পথ বেছে নিয়েছেন। আজ মঙ্গলবার কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েস অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কী-নোটে এই দাবি করা হয়।

কাজী আব্দুল হান্নানের উপস্থাপিত কী নোটে বলা হয়, করোনা মহামারির সময়েও ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বাড়ানো হয় ২০২০ সালের এপ্রিলে। এরপর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে আরেক দফা বাড়ে দাম। এ ২ দফায় আবাসিকে প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম বেড়েছিল ৩ টাকা ৬১ পয়সা (৩১ শতাংশ) এবং বাণিজ্যিকে বেড়েছিল ৪ টাকা ৯৬ পয়সা (১৩ শতাংশ)।

জনগণকে একটি অতিপ্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা আবারও ২০ শতাংশ পানির দাম বাড়াতে চায় ঘাটতির টাকা তুলতে৷ অথচ সংস্থাটির অপ্রয়োজনীয় ব্যয় সংকোচন করেই ঘাটতির টাকা সমন্বয় করা সম্ভব। এর জন্য মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হয় না।

কেন ঘাটতি: তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিকে কারণ দেখিয়ে ঢাকা ওয়াসা প্রতি হাজার লিটার পানির উপাদন খরচ ২৫ টাকা দেখিয়ে বলেছে, তারা ১০ টাকা কমে ১৫ টাকায় বিক্রি করছে। সরকার এই টাকা ভর্তুকি দেয়, যা আর দিতে চায় না। এ অবস্থায় এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান সংস্থাটির অমিতব্যয়িতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি-অপচয়ের সব দায়ভার ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে ভর্তুকি কমানোর পথ বেছে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'সরকারের কাছ থেকে ভিক্ষা নিয়ে কোনো সংস্থা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না৷ কিন্তু ঢাকা ওয়াসা হচ্ছে একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান, লাভ বা বানিজ্য এর উদ্দেশ্য নয়। অথচ সেবার চেয়ে বানিজ্যের দিকেই এর নজর এখন বেশী। দেশে বিভাগীয় শহর গুলোতে আরও ৬টি ওয়াসা আছে। তাদের পানির দাম ঢাকা ওয়াসার চেয়ে প্রায় ৩ ভাগের ১ ভাগ। হাজার লিটারের ইউনিট প্রতি খরচ এত বেশী না বলেই তারা পারছে।

অন্যদিকে সারা দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কোথাও পৌর কর্তৃপক্ষ, কোথাও পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং পানি সরবরাহ করে। সেগুলোর বেশিরভাগই প্রকল্প হিসেবেই সরকারি টাকায় পরিচালিত হয়। সেগুলোতে যে বিপূল ভর্তুকি দেওয়া হয় তাও কি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে? যদি তা না হয় তবে ঢাকায় ভর্তুকি বন্ধ করে সরকার কি এক দেশে পানি সরবরাহ বাবদে বৈষম্য মূলক ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে?

বিষয়টি কি সত্যি এমন?: বর্তমানে আবাসিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। ওয়াসার বোর্ড মিটিংয়ে প্রস্তাব ছিল আবাসিকে এ দর ২১ টাকা ২৫ পয়সা করা। আর বাণিজ্যিক সংয়োগের ক্ষেত্রে প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম বর্তমানের ৪২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৮ দশমিক ৮ টাকা করা। আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন দর কার্যকর করতে অনুমোদন চায় ওয়াসা। কিন্তু এই মূল্যবৃদ্ধির কথা প্রকাশ হলে চারদিকের সমালোচনার মুখে এমডি ৩৮ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব কমিয়ে ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠাবেন বলে জানান। সামগ্রিক বিষয়টি খতিয়ে দেখলে দেখা যায়, পানির দাম ২০ শতাংশ বাড়লে ভোক্তা পর্যায়ে কার্যত বৃদ্ধি পাবে ৪৬ শতাংশ। প্রতিটি পানির বিলে সমপরিমান সুয়ারেজ বিল দিতে হয়। আর মোট বিলের ওপর ১৫ শতাংশ দিতে হয় ভ্যাট। ফলে ১০০ টাকার পানির বিলে বর্ধিত ২০ টাকা, সুয়ারেজ বিল বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ২৪০ টাকা। বর্ধিত ৪০ টাকার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাটে আরও ৬ টাকা মিলিয়ে মোট বিলে ২০ শতাংশ এর ভর দাঁড়াবে ৪৬ টাকা। যার অর্থ হচ্ছে পানির ১০০ টাকা বিলে ভোক্তাকে গুনতে হবে ২৪৬ টাকা।

এই বাড়তি খরচ কার বাবদে করতে হবে?

যে ওয়াসা নিরাপদ পানি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

যার পানি কিনে ফুটিয়ে পান করতে হয়।

অন্যথায় যার পানি খেতে হলে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে ফিল্টার কিনে রাখতে হয়।

যে পানি পাশে রেখে ১৫ টাকা দিয়ে এক গ্লাস পানির সমান বোতলজাত পানি কিনে খেতে হয়।

সেই ওয়াসায় এমডি হিসেবে ২০০৯ সালের অক্টোবরে তাকসিম এ খান নিয়োগ পেয়ে এ পর্যন্ত পানির দাম বাড়িয়েছেন ১৪ বার। আর নিজের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে নিয়েছেন ৪২১ শতাংশ।

ভিক্ষা করে চলা এই সংস্থার প্রধান নির্বাহী এখন মাসিক বেতন নেন সোয়া ৬ লাখ টাকা। এমডি হিসেবে ৩ বছরের জন্য চুক্তিতে তিনি যখন নিয়োগ পান, তখন তার সর্বমোট মাসিক বেতন ছিল ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।

প্রতিবার পানির দাম বৃদ্ধির সময় প্রচার করা হয় ভর্তুকির কথা। ভর্তুকির কারণ দেখানো হয় তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিকে। সঙ্গে থাকে পানির স্তর নেমে যাওয়া। তথা খরচ বৃদ্ধিটা মূলতঃ গভীর নলকূপের খরচ। ঢাকা ওয়াসা ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহ করে ৬৫ ভাগ। যার উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিকে অজুহাত হিসেবে সামনে আনা হয়। বাকি ৩৫ ভাগ নদীর পানি পরিশোধন ও সরবরাহ ব্যয় প্রসঙ্গ উহ্য রাখা হয়। নন রেভিনিউ ওয়াটার বা সিস্টেম লস হিসেবে দেখানো চুরি বন্ধের কোনো উদ্যোগ সম্পর্কে থাকে না কোনো তথ্য।

অপর দিকে বেতন বোনাস বৃদ্ধির সময় এমডি হিসাব দেন, ঢাকা ওয়াসা লাভের দিকে যাচ্ছে। মাত্র ১ বছর আগে তিনি বলেছিলেন, এক সময় যেখানে ৭০০ কোটি টাকা রেভিনিউ পাওয়া যেত এখন সেখানে ৭ হাজার কোটি টাকা আসছে। গত বছরও তারা ৪০ কোটি টাকা মুনাফা দেখিয়ে ইন্সেন্টিভ বোনাস নিয়েছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, যে সংস্থা ভিক্ষা করে চলে-সেই সংস্থার প্রধান নির্বাহীর বেতন কি সোয়া ছয় লাখ হওয়া উচিত? কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ২ ঈদে দুই বোনাস ছাড়াও ৪টি ইন্সেন্টিভ বোনাস দেওয়া কি যুক্তিযুক্ত?

রয়েছে অদৃশ্য আয়ের হরেক খাত: দেখা গেছে, পানির দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে অনেক বড় অদৃশ্য আয়ের ব্যবস্থা করা হয়। ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহ প্রাপ্ত এলাকার ৭০ শতাংশ এলাকাই সুয়ারেজ সেবা বহির্ভূত। অথচ তাদের কাছ থেকেও অন্যায়ভাবে পানির বিলের সঙ্গে জুলুম করে সুয়ারেজ বিল আদায় করা হয়। প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতি এবং তার মূল্য শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদেরই বহন করতে হয়। ঢাকা ওয়াসার ১১টি দুদক চিহ্নিত দুর্নীতি এবং সরকারি অর্থের অপচয় নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো মাথাব্যথা দেখায়নি ওয়াসা। নতুন আরেক খাত বের করা হচ্ছে, বিত্তবান আর সাধারণ মানুষের বসতি এলাকার শ্রেণীভেদ করে পানির দাম নির্ধারণের মাধ্যমে। যেন উচ্চবিত্তের পশ এলাকায় সাধারণের এবং সাধারণের আবাসিক এলাকায় বিত্তশালীদের থাকতে নেই। নাকি নতুন লেনদেনে ভোক্তার শ্ৰেণীভেদ পরিবর্তনের করে বিলে হেরফের করার ক্ষমতা অর্জন করাই এর লক্ষ্য এখনও বোঝার সময় হয়নি। এক কথায় ওয়াসার অমিতব্যয়িতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি-অপচয়ের দায়ভার ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা থেকেই ওয়াসায় চলে এই মূল্য বৃদ্ধির খেলা। অথচ ভোক্তাদের তা বাধ্য হয়েই সহ্য করতে হয়। একটা পক্ষ হওয়া সত্ত্বেও একতরফা চাপিয়ে দেওয়ার সময় ভোক্তাদের এ নিয়ে কথা বলার কোনো জায়গা নেই৷

এখন কেন?: গত ১০ বছরে দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে ৩ গুণ। এর মধ্যেই বিদ্যুতের দাম ৬৭ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। গত বছর গ্যাসের অভাবে জ্বালাানি তেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়। জ্বালানির সঙ্কটে এলএনজি এনে তার দাম সমন্বয় করায় বিদ্যুতে খরচ আরও বাড়বে। যা বিবেচনায় রেখে ৬৭ শতাশং বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আবার দেশীয় কোম্পানির গ্যাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড এবং সিলেট গ্যাস ফিল্ড এ সময় ৫০ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। এদের প্রত্যেকেই লাভজনক প্রতিষ্ঠান, তারপরও তারা দাম বাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে। সামগ্রিক ভাবে গ্যাস খাতে ভর্তুকি অনেক কমে যাওয়ায় পেট্রোবাংলা এখন অনেক লাভজনক অবস্থায় আছে। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করে সিএনজির সঙ্গে সমন্বয় করে তারা লাভবান হয়েও ১১৭ শতাংশ মূল্য বাড়ানো প্রস্তাব করেছে। এ দিকে সঞ্চালন-বিতরণ কোম্পানিগুলোর সবাই লাভে থাকার পরও মূল্য বাড়াচ্ছে।

একদিকে ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে দেশের সব ক্ষেত্রেই দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেছে। তার ওপরে আবার সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের সকল দ্রব্য মূল্যে আরও একদফা উল্লম্ফন ঘটতে শুরু করেছে। অনিয়ন্ত্রিত দ্রব্যমুল্যের বৃদ্ধিতে নির্দিষ্ট আয় দিয়ে সংসার চালানো যখন অসম্ভব, তখন পরিবার প্রধানরা পরিবার পরিচালনার জন্য, অধিক আয়ের জন্য দিশেহারা হয়ে উঠেছেন। করোনার প্রত্যক্ষ প্রভাবে কর্মহীন হয়ে পড়েছে বেসরকারি খাতের বিরাট এক অংশ। সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ের চাকরিজীবীরা পরিবারের চাহিদা পূরণ করতে দূর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে। মহা বিপদে আজ দেশের সাধারন জনগন! ঢাকা ওয়াসা বোধ করি ভেবেছে, এইতো সময়।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

This site uses cookies. By continuing to browse the site you are agreeing to our use of cookies & privacy Policy from www.prothom.news